Saturday, April 23, 2022

স্বপ্ন দেখার শুরু"
.
মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে।চেহারায় একরাশ
বিরক্তি আর জিদ নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে
যাচ্ছিলাম।হঠাৎ খুব জোরে কেউ একজনের গায়ের
সাথে ধাক্কা খেলাম।"উহহহ" বলে এক হাত দিয়ে
আরেক হাতের বাহু ডলতে ডলতে বললাম
-চোখে দেখতে পাওনা?হাঁটার সময় চোখ কি পকেটে
নিয়ে ঘোরো?সরি বলো
-মীম,কথা বলার সময় আগ পিছ ভেবে কথা বলবা।
ভুলে যাইয়োনা আমি তোমার সিনিয়র।
-তো?সিনিয়র বলে তুমি আমাকে ধাক্কা দিবা?
-আমিতো ইচ্ছে করে দেইনি।তোমার সাথে ধাক্কা
লাগেনাই বা তোমার পায়ে পাড়া খায়নাই এইরকম
ছেলেমেয়ে এই ভার্সিটিতে খুব কমই পাওয়া যাবে।
তাদের সবার চোখ খারাপ নাকি তোমার চোখ
খারাপ?হাঁটার সময় কোনদিকে তাকিয়ে হাঁটো?তুমি
সবকিছুতেই অস্থির।একটা মেয়ের এতো অস্থির হওয়া
ঠিক না বুঝছো?
.
মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো।সরি তো
বললোইনা উল্টো এক গাদা ঝাঁরি শুনিয়ে দিলো
আমাকে।ক্যান্টিনে গিয়ে ব্যাগটা টেবিলের উপর
ছুঁড়ে রাখলাম।তারপর ক্যাচকুচ শব্দ করে একটা
চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পা নাড়াতে লাগলাম।
.
একটু আগেই আমার জীবনের এতো বড় একটা দুর্ঘটনা
ঘটে গেছে।আমার তো কান্না করা উচিৎ।আমার
জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে কেঁদে কেটে এক
দফা বন্যায় ভাসিয়ে দিতো ভার্সিটি টাকে।অথচ
কান্না তো দূরে থাক আমার মনও খারাপ হচ্ছে না।
অনেক চেষ্টা করেও মন খারাপ করতে পারছিনা।
বরং মেজাজ খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে।কেন
জানি আমি কারোর উপর রাগ,অভিমান এইসব করতে
পারিনা,ভালোলাগা ভালোবাসা তো দূরের কথা।
যা পারি তা হলো মেজাজ গরম করে কথা বলা।
ভার্সিটির সিনিয়র জুনিয়র সবাই মোটামুটি আমার
এই মেজাজের সাথে পরিচিত।তাদের ভাষ্য অনুযায়ী
আমার এই ধরণের আচরণকে চঞ্চলতা
বলেনা,পাগলামী বলে।সার্টিফিকেট বিহীন পাগল
আমি।
.
অনেক চেষ্টা করেও কোন কষ্টের স্মৃতি মনে করতে
পারলাম না।আগে আম্মুর কথা মনে পড়লে বাথরুমে
গিয়ে পানির কল ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে
কাঁদতাম।এখন আম্মুর কথা মনে পড়লেও কান্না
আসেনা।আশ্চর্য! আমার কি কোন কষ্ট নেই তাহলে?
আম্মুর জন্য কেঁদে সব চোখের পানি শেষ করে
ফেলেছি মনে হয়।ইশশ একটু বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ
ছিলো।শেষ কবে কেঁদেছি তারিখটা মনে করতে
পারছিনা।তবে ক্লাস ইলাভেনে উঠার পর থেকে
কাঁদিনি এটা মনে আছে।
.
কি আর করা?হঠাৎ "উঁউঁউঁ "শব্দ শুনে ক্যান্টিনের সবাই
আমার দিকে তাকালো।আমি হাতের উল্টা পিঠ
দিয়ে চোখ মুছে বললাম
"কি হইছে?সবাই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?এর
আগে কাউকে কাঁদতে দেখোনি?শান্তিতে একটু
কাঁদতেও দিবানা নাকি?"
.
আমার কথা শুনে তারা একে অপরকে বললো"এই
মেয়েটা পুরাই মেন্টাল।এরেতো পাবনায় পাঠিয়ে
দেয়া উচিৎ।"
.
আমি তাদের কথায় কান দিলেও পাত্তা না দিয়ে
আবার কান্নায় মনযোগী হলাম আর উঁউঁউঁ করে আবার
শব্দ করে কাঁদতে লাগলাম।
.
-কিরে কি করিস?
দীপা,(আদর করে দীপু ডাকি)আমার একমাত্র বন্ধু ।
আমার পাশের চেয়ারটাতে বসে কথাটা জিজ্ঞেস
করলো।আমি নিচের ঠোঁটটা ফুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে
বললাম
-দেখছিসনা কাঁদছি?উঁমমমম………
-কাঁদছিস?কই?চোখে পানি নেই,ফেইসে ইমোশোন
নেই।এটা কেমন স্টাইলের কান্না?
-আমার স্টাইল।আমি কেন কাঁদছি সেটা জানতে
চাচ্ছিস না কেন?
-না জানতে চাইলেও বলবি এইটা আমি জানি
-দীপুউউউউউউউউউউ… আমি শেষ… এঁএঁএঁ
-কিভাবে?
-রাজীবের সাথে ব্রেকআপ এঁএঁএঁ
-কিইইই?আল্লাহ তুই ছ্যাকা খাইয়া এখানে বসে ভ্যা
ভ্যা করে নাক কাঁদছিস?তোর তো উচিৎ বাসায়
গিয়ে কান্না করে বালিশ ভিজিয়ে ফেলা
-তোর মনে হয় আমি ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো মেয়ে?
আরেন্নাহ,আমি ওই হারামীরে ছ্যাঁকা খাওয়াইছি।
আমি ব্রেকআপ করছি ওর সাথে
-কালকের রিলেশন আজকেই ব্রেকআপ?তুই নিজেইতো
রাজীবকে বললি তুই ওকে বয়ফ্রেন্ড বানাতে চাস
-ধ্যাত্তেরি!এইসব ফিলিংস,ইমোশন,লাভ আমার
মধ্যে নাই।আর রাজীব্বা গুন্ডাটার মধ্যেও নাই।
হ্যাতের তাকানোর স্টাইল দেখেই বুঝছি হ্যাতের
মতলব কি?পাগল মেয়েরে ভালোবাসা যায়না কিন্তু
ঠিকই অন্য কিছু … হেহেহেহেহ
-ওররে সাংঘাতিক!বেঁচে গেলি মনে হচ্ছে।চল এই
খুশিতে কিছু খাওয়াবি।
-জুস খাবো।তুই খাওয়াবি।জানোসই তো আমি বড়লোক
বাপের ফকির মেয়ে।আর শোন আমি আজকে তোর
বাসায় থাকবো।আমার বাসা নামক নরকে গিয়ে
আজকে আর কোন ঝামেলা বাড়াতে চাইনা।
.
"আমার আগের সেই নীরবতা,সেই গম্ভীরতা সব
কোথায় গেলো।আম্মু মনে হয় যাওয়ার সময় সব নিয়ে
গেছে।নাহলে হঠাৎ করেই কেন এতো চঞ্চল আর
উশৃঙ্খল হয়ে গেলাম?"
ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো ভাবছি।হঠাৎ
দেখলাম জ্যাম এ আটকা পড়া একটা গাড়ির
ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভার সাহেব নিশ্চিন্ত
মনে হা করে ঘুমুচ্ছেন।একটা মাছি উনার মুখে ঢুকছে
আর বেরোচ্ছে।কয়ঘন্টা জ্যামে বসে আছে আল্লাহই
ভালো জানে। উনার কানের কাছে চিৎকার করে
"বাচ্চাআআআওওওও,এক্সিডেন্ট… " বলে দিলাম
একটা দৌড়।পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম লোকটা
হতবম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।তার ঠোঁট
নড়া দেখে বুঝতে পারলাম আমাকে নিশ্চয়ই গালি
দিচ্ছে।
.
ক্লাস শেষে হেলে দুলে হেঁটে হেঁটে বাসায়
ফিরছিলাম আর আশেপাশের দোকান,
অফিস,সাইনবোর্ডের লেখাগুলো পড়ছিলাম।
পার্কিং এ রাখা একটা গাড়ির জানালার আয়নার
সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করলাম।তারপর কি ভেবে
যেন গাড়ির চাকায় খুব জোরে একটা লাথি দিলাম।
ব্যাথায় উহ করে পিছনে ফিরলাম।আমার ঠিক
সামনেই আবিদ নামের সেই ঝাঁরিওয়ালা সিনিয়র
আমার দিকে মেজাজ গরম করে চোখ বড় বড় করে
তাকিয়ে আছে।আমি একটু হেসে চলে পাশ কাটিয়ে
যাওয়ার সময় ডাক দিলো
-এই দাড়াও,কোথায় যাচ্ছো তুমি?
-কেন?বাসায় যাচ্ছি
-আমার গাড়িতে লাত্থি দিলা কেন?
-এএটা তোমার গাড়ি?(মনে মনে ভাবলাম মীম তুই
আজকে শেষ।জমের হাতে পড়ছিস তুই।ভয়ে একবার
ঢোক গিললাম।)
-এটা তোমার গাড়ি?আল্লাহ তোমার গাড়ি আছে?
জানতাম নাতো?তোমার গাড়িটাতো অনেক সুন্দর।
(এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে পালানোর পথ
খুঁজছিলাম।)
-এই আমার দিকে তাকাও,লাত্থি দিছো কেন বলো?
-আমি জানতাম না এটা তোমার গাড়ি।জানলে
কখনোই লাত্থি দিতামনা।সত্যি
-আমার গাড়ি হোক আর যার গাড়ি হোক লাত্থি
দিবা কেন?
-বললামতো সরি
-তুমি এখনো নিজের অস্থিরতা কমাও নি?আর যদি
কখনো দেখি রাস্তায় ফাইজলামি করতেছো তো
দেইখো কি করি?
-আচ্ছা ঠিক আছে।
.
কয়েকপা সামনে এগিয়ে আবার পেছন ফিরে
দেখলাম আবিদ গাড়িতে উঠে বসেছে।দ্রুত পায়ে
হেঁটে গিয়ে আবার গাড়ির চাকায় দুইটা লাথি মেরে
উল্টো দিকে দিলাম দৌড়।আবিদ গাড়ি থেকে
নেমে বলছিলো "এই মীম,এই ফাজিল মেয়ে দাড়া
বলতেছি।দাড়া কাল ভার্সিটিতে গেলে তোর খবর
আছে।"
.
আমি দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছি কয়েকমাস
আগেইতো পড়াশোনা শেষ করে ভার্সিটি থেকে
বিদায় নিছো।শুধুমাত্র আমাকে ঝাঁরি দেয়ার জন্য
তুমি ভুলেও ভার্সিটিতে আসবানা।
.
মনটা খুব খারাপ।একটু আগেই দীপা বলেছে ওর থেকে
ধার নেয়া টাকাগুলো ফিরিয়ে দিতে,ওর নাকি খুব
দরকার আছে।এইদিকে আমার ব্যাগ খুঁজলে একটা
পাঁচটাকার কয়েন ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবেনা।খুব
টেনশনে আছি।এক হাতে মোবাইলে গেইমস খেলছি
আরেক হাতে জুসের প্যাকেট।মাঝে মাঝে জুসের
স্ট্রতে অল্প করে টান দিচ্ছি।গেইম ওভার হয়ে
যাওয়ায় মন আরও খারাপ হলো।জুসটা থেকেও আর
স্বাদ পাচ্ছিনা তাই পুরোটা শেষ না করেই জুসটা
পেছনের দিকে ছুঁড়ে মারলাম।সাথে সাথেই একটা
বিকট শব্দ শুনে পেছন ফিরলাম।তাকিয়ে দেখি
একটা গাড়ি পিলারের সাথে লাগানো আর
ড্রাইভারের সিট বরাবর গাড়ির সামনের ভাঙা
গ্লাস বেয়ে কমলা রঙের তরল কিছু গড়িয়ে পড়ছে।
গাড়ির উপর পড়ে থাকা জুসের প্যাকেটটা দেখেই
আমার চোখ কপালে উঠে গেলো।আবিদকে গাড়ি
থেকে নামতে দেখেই ব্যাগ খুলে মোবাইলটা ব্যাগে
রেখে আবার দৌড়।আমাকে আর পায় কে?আবিদ
পেছন পেছন কিছুক্ষণ দৌড়েছিলো কিন্তু একটা
বাড়ির ভেতর ঢুকে যাওয়াতে আমাকে আর দেখতে
পায়নি।
.
আজিব তো!গেলো কোথায়?মেজাজটা খারাপ
লাগেনা?বালিশের নিচে,বিছানার চাদর
উল্টে,টেবিলের উপর বই খাতার ভাজ সব খুঁজে
ফেলেছি কিন্তু কোথাও পাচ্ছিনা।
-কি খুঁজছিস?আমাকে বল, খুঁজে দেই
- কোন দরকার নেই।আমার কাজ আমি নিজেই করতে
পারবো
-তুই আমাকে মা হিসেবে এক পয়সারও দাম দিস না
কেন?
-কারণ তুমি তো আমার মা নও।তুমি আমার সৎ মা।
তোমার স্বামীকি বাসায় আছে নাকি?হঠাৎ এতো
দরদ দেখাচ্ছো যে?
-আমাকে মা ডাকিস না ভালো কথা তাই বলে
নিজের বাবাকেও বাবা ডাকবিনা?
-না ডাকবোনা।উনি এখন আর আমার বাবা না,উনি
তোমার স্বামী আর তোমার সন্তানদের বাপ।আমার
কেউ নেই।আমার আম্মুতো সেই কবেই মারা গেছে
আর তারপর আব্বু যেদিন তোমায় বিয়ে করেছে
সেদিন থেকে আমার আব্বুও আমার নেই আর।
-তুই তো আগে এমন ছিলিনা?মা মা বলে আমাকে
পাগল করে ফেলতি।পড়ালেখা করতি,সুন্দর করে
চলাফেরা করতি আর এখন?
-ওমা!হঠাৎ আমার এতো প্রশংসা?তোমার কাছে
আমি ভালো ছিলাম কবে?যেই আব্বু কখনো আমাকে
বকা দিতোনা তুমি আসার পর সেই আব্বু আমার গায়ে
হাত তুলেছে।আমি আর কথা বাড়াতে চাইনা।এতোই
যখন দরদ দেখাচ্ছো তখন তোমার স্বামীর কাছ থেকে
দশ হাজার টাকা এনে দাও।সেটাও তো পারবানা।
এখন যাও
.
-হ্যালো দীপু,তোর বাসায় কি আমি আইডি কার্ডটা
ফেলে এসেছি?কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা
- তোর ব্যাগে দেখনা
-দেখেছিতো কিন্তু নাই
.
একের পর এক টেনশন।এখন আইডি কার্ডটা কোথায়
পাবো?টেনশনে ঘুম আসছিলোনা তাই শুয়ে শুয়ে
গেইম খেলছি।এতো রাতে আননোন নাম্বার থেকে
কল?হুমমমম,বুঝতে পারছি।এটা নিশ্চয়ই রাজিব্বা
গুন্ডার কাজ।ওর নাম্বার ব্ল্যাক লিস্টে রেখেছি
বলে এখন আননোন নাম্বার থেকে কল দিচ্ছে।দাড়া
আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
-হ্যালো
-আরে রাখ তোর হ্যালো।তুই ফোন দিছস ক্যান
আমারে?তোর কি লজ্জা নাই?আমারি ভুল হইছে
আসলে।আমি সেইদিন তোর দুইগালে দুইটি থাপ্পড়
দেয়া উচিৎ ছিলো।বদমাইশ কোথাকার
-হ্যালো হ্যালো হ্যালো,মীম বলছো?
-না আমি তোর আম্মা।
-এই তোমার সমস্যা কি?মানুষের সাথে এইভাবে কথা
বলো কেন?
-তুই তো মানুষ না যে তোর সাথে সুন্দর করে কথা
বলবো।দ্যাখ রাজিব্বা গুন্ডা আর যদি কখনো
আমাকে ফোন দিছস তো তোর গাল আর আমার হাত।
মনে রাখিস।ফোন রাখ হারামী
-মীম,একটু চুপ করবা তুমি?আমি কোন রাজিব্বা গুন্ডা
ফুন্ডা না
-তাইলে তুই কে?আই মিন তুমি কে?
-আবিদ,এই খবরদার ফোন রাখবানা।
.
নামটা শুনেই জিহবা কামড় দিলাম।মাইরালাইছে!এই
ছেলেতো আসলেই ডেঞ্জারাস।ফোন নাম্বারও
যোগাড় করে ফেলেছে।এখন আবার ঝাঁরি।
-হ্যালো হ্যালো,কোন আবিদ তুমি?আমি তো ঠিক
চিনতে পারছিনা
-আবার ফাইজলামী?
-ও আচ্ছা,তুমি আবিদ?আমার ভার্সিটির সিনিয়র
ভাইয়া!কেমন আছো?
-মজা নিবানা বুঝছো?আমি তোমার সাথে পিরিতির
আলাপ করার জন্য ফোন দেইনি।
-পিরিতির আলাপ?বাই দ্যা ওয়ে আমার নাম্বার
তোমাকে কে দিয়েছে?রাজিব্বা তাইনা?
-তোমার আইডি কার্ডটা যেন কোথায়? (এইরে!এখন
মনে পড়েছে।মোবাইল রাখার জন্য যে ব্যাগ
খুলেছিলাম তখন আর ব্যাগের চেইন না লাগিয়েই
তো দৌড়েছিলাম।আইডি কার্ডটা তখনই পড়ে গেছে
নিশ্চয়ই।)
-আল্লাহ!ওটা তোমার কাছে?তুমি এতো ভালো?
আমার আইডি কার্ড ফেরত দেয়ার জন্য ফোন দিছো!
আসলে মানুষ ঠিকই বলে,তোমাদের মতো ভালো
মানুষদের জন্যই আমাদের পৃথিবীটা টিকে আছে
এখনো।নইলে কবেই ধ্বংস হয়ে যেতো,বুঝছো?
-কাজ নাই আমার আর?তোমার কারণে আজকে আমার
গাড়ির হেডলাইট আর গ্লাস ভাংছে।পঞ্চাশ হাজার
টাকা লাগতেছে ঠিক করার জন্য।কালকের মধ্যে
টাকাগুলো দিবা তুমি মিস নুজহাত মাহিরা মীম
-আমি কেন দিবো?আজিব ব্যাপার!আর হেডলাইট আর
গ্লাস ঠিক করতে পঞ্চাশ হাজার টাকা?মজা লস?আই
মিন মজা নাও?
-গাড়ির চাকায় তিনটা লাত্থি দিছিলা যে মনে
নেই?
-তো?চাকা ফেটে গেছে নাকি?
-নাহ,জরিমানা সহ পঞ্চাশ হাজার টাকা
-এক টাকাও দিবোনা আমি
-দিবানা?আইডি কার্ড নিতে আসবানা আমার
কাছে?
-মাথা খারাপ নাকি?আমি নতুন আইডি কার্ড
বানিয়ে নিবো।তবুও তোমার সামনে যাবোনা।তুমি
আমাকে আর পাবাওনা
-সিম চেঞ্জ করবা?করো!ভার্সিটিতে আসাও বন্ধ
করে দিবা?করো! তোমার বাসা চিনতে আমার একটুও
সময় লাগবেনা।
-তার মানে তুমি আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়েই
ছাড়বা?
-এক্সেক্টলি
-তোমার অফিসের এড্রেস বলো,আমি দিয়ে আসবো
-এতো কষ্ট করতে হবেনা তোমার।আমি কালকে
ভার্সিটিতে আসবো।টাকাটা দিবা আর আইডি
কার্ড নিবা।
-কালকে?মগের মুল্লুক নাকি?সময় লাগবে আমার
-কতো সময়?
-বললাম তো দিয়ে দিবো।
.
এমনিতেই টাকা পয়সার সংকট তার ওপর আবার নতুন
ঝামেলা।একটু আগেই তো দীপাকে দেয়ার জন্য
আব্বুর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিলাম।এখন
আবার পঞ্চাশ হাজার টাকা?আর এই লোকটা যে
নাছোড়বান্দা।টাকা না পাওয়া পর্যন্ত আমার পিছু
ছাড়বেনা।
.
প্রায় এক মাস হয়ে গেলো।আবিদ প্রতি রাতেই
আমাকে কল করে জানতে চায় টাকা কখন দিবো।
মাঝে মধ্যে ভার্সিটির সামনেও আসে।আমি আজ
দিবো কাল দিবো করে ওকে ঘুরাচ্ছি।আমি বুঝিনা
এতো টাকাপয়সার মালিক হয়ে পঞ্চাশ হাজার
টাকার জন্য আমার পিঁছে ঘুরছে কেন?আসলে ঠিক!
কিপটা আর দয়াহীন মানুষরাই ধনী হয়।আমাকে
যতোবার ফোন করেছে আর যতোবার টাকার জন্য
ভার্সিটির সামনে এসেছে তাতে মনে হয় ওর আরও
পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।তবুও আমার
কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ও নিবেই।আইডি
কার্ড অবশ্য আগেই ফিরিয়ে দিয়েছিলো।
.
ভার্সিটির রাস্তা ধরে হাটছি।আমার পাশেই
আবিদের গাড়ি থামলো।আমি ওর দিকে করূণ মুখ
নিয়ে তাকিয়ে আছি।যদি একটু মায়া হয় আমার জন্য।
দেখা যাক কি বলে?
-কোথায় যাচ্ছো?
-বাসায়
-গাড়িতে ওঠো
-কেন?
-ওঠো বলছি,না উঠলে কিন্তু এক্ষুনি থানায় ফোন
করবো।
.
কথায় কথায় একদিন ভুল করে আবিদকে বললাম যে
আমি আমার বাবাকে না সবথেকে বেশি ভয় পাই
পুলিশকে।এই খাকি পোশাক পড়া লোকগুলোকে
এতো ভয় পাই কেন আল্লাহই জানে!আর তাই আবিদ
সারাক্ষণ আমাকে পুলিশের ভয় দেখায়।কি আর
করা?অনিচ্ছা সত্বেও গাড়িতে উঠে বসলাম।বললাম
-আজকে তোমার একটা এক্সিডেন্ট হবে
-এক্সিডেন্ট?কেন?
-আমি তোমার গাড়িতে বসেছি তাই।তোমার
গাড়িতো আর ভুলে যায়নি আমি তার সাথে কি কি
করেছিলাম
-হাহাহা,এইটা আমার সবথেকে প্রিয় গাড়ি।আমি এই
গাড়িতে অন্য কাউকে উঠতে দেইনা।কেউ টাচ
করারও সাহস পায়না আর তুমি?(বলে আমার দিকে
চোখ গরম করে তাকালো)
-তোমার আরও গাড়ি আছে?
-নাহ,এটাই শুধু।সবথেকে প্রিয় বলতে বোঝালাম
বাইক,সাইকেল,পিসি,এইসবের প্রতি আমার তেমন
ইন্টারেস্ট নেই,সময়ও দেইনা।আর এই গাড়ি নিয়েই
সারাক্ষণ ঘুরাঘুরি করি।লংড্রাইভে যাই
.
কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আবিদের মন আজ বেশ
ফুরফুরে।টাকার কথা হয়তো ভুলেই গিয়েছে।আর যেন
মনে না আসে আমি সেই চেষ্টাই করছিলাম।কোথায়
নিয়ে যাচ্ছে তাও জানিনা,জিজ্ঞেসও করতে
পারছিনা কারণ এরপর যদি আবার টাকার কথা বলে।
আমি বললাম
-লংড্রাইভে?গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে?
.
আবিদ আমার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো।তারপর
আবার সামনের দিকে তাকিয়ে বললো
-আমার টাকাটা কবে পাচ্ছি?
-টাকা?এইতো কয়েকদিনের মধ্যেই দিয়ে দিবো
-আমার মনে হয় তুমি এক টাকাও যোগাড় করতে
পারবেনা।তার চাইতে তুমি অন্যভাবে শোধ করে
দাও
-কিভাবে?
-আমি তোমাকে একটা চাকরি দিবো।প্রতি মাসে
পাঁচশ টাকা যা আমি তোমাকে দিবোনা।পঞ্চাশ
হাজার টাকা থেকে কাটা পড়বে
-মাসে পাঁচশ টাকা এটা কেমন চাকরি?আজকাল
ফকিররাও তো দিনে দুই আড়াই হাজার আয় করে।আর
এভাবে পঞ্চাশ হাজার টাকা শোধ করতে তো পুরো
জীবন চলে যাবে।যাইহোক চাকরিটা কি?
-আমার বাসার কাজের মেয়ে
-কিইইইইইইইইইইইইইইই?ছিইইইইইইইইইইইইইই!আমি আপনার
বাসার কাজের মেয়ে হবো?আপনি ভাবলেন কি
করে?একটাকাও পাবেননা আপনি
.
আমার কথা শুনে আবিদ গাড়ি থামালো।বললো
-ওকে তাহলে আমি পুলিশকে কল
-আরেহ না না না না না।কল করতে হবেনা।আমি
কালকেই আপনার টাকা দিয়ে দিবো।আই প্রমিস।
.
গাড়ি থেকে নেমে গেলাম।নাহ,যেখান থেকেই
হোক কালকে ওর টাকাটা ওকে দিতেই হবে।তাতে
যদি অন্তত ও পিঁছু ছাড়ে।নয়তো কাজের মেয়ে হতে
হবে বা জেলে যেতে হবে।বাবার কাছে টাকা
চাইলাম কিন্তু দিলোনা।উপায় না পেয়ে মায়ের
চুড়িজোড়াই বিক্রি করে দিলাম।ছলছল চোখে
কাঁদো কাঁদো স্বরে দোকানদারকে বুঝিয়ে বললাম
এই চুড়ি জোড়া যেন আর কোথাও বিক্রি না করে।
আমার টাকা হলে আমি কিনে নিবো আবার।
.
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।রাস্তার পাশের
ল্যাম্পপোস্টের নিচে সাথে আনা ট্রলি ব্যাগটার
উপর বসে আছি।বাসায় ফিরে যাবো কিনা ভাবছি।
কিন্তু বাসা থেকে চিরতরে বের হয়ে আবার বাসায়ই
ফিরে যাবো?কক্ষনো না।আমাকে না জানিয়েই
আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললো?তাও আবার সৎ
মায়ের ভাইয়ের ছেলের সাথে!অসম্ভব।আমি
কিছুতেই বিয়ে করবোনা।উপায় না দেখতে পেয়েই
বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসলাম।দীপা রা সবাই
নাকি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে তাই ওর বাসায়ও
যেতে পারছিনা।এখন কোথায় যাবো?হঠাৎ চোখের
উপর গাড়ির আলো পড়ায় চোখের সামনে হাত দিয়ে
চোখকে রক্ষা করছি।হাত সরিয়ে দেখলাম আবিদ
আসছে।দৌড়ানোর মুডে ছিলাম না তাই বসে রইলাম।
-এইযে লেডি গুন্ডা,আপনি এখানে?
.
ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার রাস্তায়
চলা গাড়ি গুলো দেখায় মনোযোগ দিলাম।ও আবার
বললো
-কোথায় থাকেন আপনি?সেইযে বিশ হাজার টাকা
পাঠিয়ে উধাও হয়ে গেলেন আর তো খবর নেই
আপনার।ফোনও সুইচড অফ করে রেখেছেন।
-আমার কাছে আর টাকা নেই।
-নেই বললেতো হবেনা।পুলিশকে ফোন দিবো?তুমি
চিন্তা কইরোনা আমি পুলিশকে বলে দিবো
তিনমাসের বেশি যেন তোমায় না রাখে
.
থানায় তো কিছুতেই যাবোনা আমি।পুলিশ গুলো
আরও বেশি খারাপ হয়।তার চাইতে বরং ওর শর্তে
রাজি হলে থাকার একটা জায়গাও হয়ে যাবে।মনে
মনে এসব ভেবে বললাম
-আমি তোমার শর্তে রাজি আছি
-আমার কি শর্ত?
-বললানা তোমার বাসার কাজের মেয়ে হয়ে
থাকতে?
.
এতো বড় একটা এপার্টমেন্ট দেখে আমার চোখ তো
ছানাবড়া হয়ে গেলো।মনে হচ্ছে যেন শো পিসের
দোকানে এসেছি।কি সুন্দর করে সব সাজানো।মনে
হচ্ছে এখানে কেউ থাকার জন্য না কেবল
সৌন্দর্যের জন্যই সাজিয়ে রাখা হয়েছে।দোকানে
যেমন কিছু জিনিসের উপর লেখা থাকে হাত
লাগাবেননা এখানেও মনে হচ্ছে সেইরকম
জিনিসপাতিতে হাত লাগানো নিষেধ।আমি ঘুরে
ঘুরে দেখছিলাম
-এ বাসায় আর কে কে থাকে?
-কেউনা,আমি একাই
-তোমার আব্বু আম্মু?
-তারা তাদের বাসায়।এখানে আমি একাই থাকি।
.
জানতে পারলাম ওর আব্বু আম্মু বিজনেস,মিটিং,পা
র্টি,এব্রোড এইসব নিয়েই ব্যাস্ত থাকে।ওকে দেয়ার
মতো সময় উনাদের নেই। উনাদের সাথে থাকলে
সারাক্ষণ ব্যাবসা বাণিজ্য নিয়ে কথা বলে আর
উনাদের বাসায় দুদিন পর পর পার্টি হয়।এসব
আবিদের কাছে ভালো লাগেনা বলেই ও এইবাসায়
একা থাকে।এইসব কথা শুনে ঢোক গিললাম।আবিদ
আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো
-ভয় পাচ্ছো?আমি কিন্তু ওইরকম ছেলে না
-মানে আমি আর তুমি?মানে শুধু আমরা দুজন?এই
বাসায় একা থাকবো?কিভাবে সম্ভব?
-দুজন একা কিভাবে হয়?আর বললাম তো আমি ওইরকম
না।তুমি ওইযে ওই ঘরটাতে থাকবে।আর শোনো
ঘুমাবার আগে রুমের দরজা লাগাতে ভুলবানা কিন্তু
-দরজা লাগাতে বলছো কেন?তুমি না বললা তুমি
ওইরকম ছেলেনা?
-হতে কতক্ষণ?
.
আবিদের সাথে প্রায় এক সপ্তাহ একই বাসায় আছি।
এখান থেকেই ভার্সিটিতে আসা যাওয়া করি।আবিদ
আসলেই অন্য ছেলেদের থেকে আলাদা।কখনো
আমার দিকে খারাপ চোখে তাকায়নি।ভুল করেও
কখনো আমার হাতও স্পর্শ করেনি।ওকে যতই দেখতাম
ততোই ভালো লাগতো।এমনটা এর আগে কখনো হয়নি।
কখনো কোন ছেলের জন্য এমন ভালোলাগা তৈরী
হবে তা ভাবিওনি।বাবা একবার ফোন করে বাসায়
ফিরতে বলেছিলো।আমি বললাম আমি গার্লস
হোস্টেলে আছি আর ভালো আছি।
.
এ বাড়িতে আসার পর নিজেকে কেমন কর্ত্রী মনে
হচ্ছিলো।আমি যদিও রান্না করতে পারিনা তবুও
চেষ্টা করতাম আর আবিদ আমাকে শিখিয়ে দিতো।
ও মাঝে মাঝে বলে
-আমি বুঝিনা এই বাড়িতে তুমি কাজ করতে এসেছো
নাকি আমি?সব কাজ আমাকেই করতে হয়।মাসে
দুইশো টাকা করে হিসেব হবে তোমার
-বারে!তুমি এই বাসায় একা থাকতে ভয় পাও,আমি
আসার পর কিছুটা সাহস পেয়েছো।সেইজন্য তো আরও
পাঁচশ টাকা বাড়ানো উচিৎ।
-আমি ভয় পাই?ভালোই বলছোতো
-এই সিগারেট ধরাবানা।তোমাকে না কতোবার
বললাম বাইরে থেকে খেয়ে আসতে এইসব?আমার
অসহ্য লাগে
-বউদের মতো শাসন করছো যে?
-বউরা এভাবে শাসন করে?আচ্ছা তোমার
গার্লফ্রেন্ডের কথাতো কিছুই বললানা।সেকি
জানে আমি এই বাসায় থাকি?
-আমি কখনো বলেছি আমার গার্লফ্রেন্ড আছে?
.
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললাম।সামনে
দাড়ানো মহিলাকে চিনতে কষ্ট হলোনা।
-স্লামালাইকুম আন্টি।কেমন আছেন?আসেন ভেতরে
আসেন
-তুমি কে?এখানে কেন?আবিদ কোথায়?
-আমার নাম মীম।নুজহাত মাহিরা মীম।বসেন আন্টি।
.
আন্টি আমার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে
আছেন।আমার পা হতে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার চোখ
বুলিয়েছেন।তার উপর আমার কথা শুনে তিনি আরও
বেশি আশ্চর্য হয়ে গেলেন।আবিদ ওর রুম থেকে
বেরিয়ে এসে বললো
- আম্মু ও মীম
-আমি ওর নাম জানতে চাইনি।জানতে চাই ও এখানে
কেন?কে ও?ওকি তোমার গার্লফ্রেন্ড?তুমি তো
বলেছো তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই?তাহলে এই
মেয়ে কে?তুমি বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছো এই
ঘরে ?আমাদেরকে না জানিয়েই বিয়ে করেছো?
এইজন্যই কি তুমি আমাদের ছেড়ে আলাদা থাকো?
-আমাকে বলার সুযোগ তো দিবা।ও আমার
গার্লফ্রেন্ড বা ওয়াইফ কিছুইনা।
-তাহলে কি তুমি লিভ টুগেদার করছো?
-আম্মু,ও আমার বাসায় কাজ করে।কাজের মেয়ে ও।
-কাজের মেয়ে?এতো পরিপাটি?দেখেতো মনে
হচ্ছেনা
.
সন্ধ্যার সময় মেঝেতে পা মেলে দেয়ালের সাথে
হেলান দিয়ে বারান্দায় বসে আছি।আবিদের মুখ
থেকে কাজের মেয়ে কথাটা শুনে কেন জানি
আমার খুব খারাপ লেগেছিলো।এর আগে কখনো
এতোটা খারাপ লাগেনি।কিন্তু আজ ওর মায়ের
সামনে বলাতে এতো খারাপ লাগছে কেন বুঝতে
পারছিনা।কেন জানি ওর উপর খুব অভিমান হচ্ছে।
চোখটা কেমন জানি ভিজে যাচ্ছে বারবার।
.
আবিদকে দেখে আমি পা গুটিয়ে নিলাম।ও আমার
পাশে এসে বসলো।এতোটা কাছাকাছি আমরা
কখনোই বসিনি।আমি ওর দিকে তাকালাম না।ও
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
-সরি
-কেন? (অভিমানের সুরে বললাম)
-আসলে আম্মুর সামনে তোমাকে
-এই জন্য সরি বলতে হবে?তুমি কি কিছু ভুল বলেছো?
-মীম আমি কিন্তু কখনোই তোমাকে কাজের মেয়ের
ভাবিনি
.
আমি কিছু বললাম না।বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে
তাকিয়ে আছে।
-তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।আমি অনেক
আগেই বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলিনি।কারণ তুমি
সেই কথাটা উপলব্ধি করার মতো মেয়ে ছিলেনা।
তাই আমি অপেক্ষা করেছিলাম।আমার মনে হচ্ছে
আজ তুমি সেই কথাটার মিনিং আর ইম্পর্টেন্স দুটোই
বুঝতে পারবা।
.
আবিদের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম
না।কি এমন কথা বলবে যার ইম্পর্টেন্স এখন বুঝবো
আমি?পরের কথাগুলো শোনার জন্য আমি ওর দিকে
আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছি।ও বললো
-দেখো মীম।মানুষের লাইফটা আসলেই অনেক অদ্ভূত।
কখন কি হয়ে যায় কেউই বুঝতে পারেনা।মানুষ সবসময়
একরকম থাকেনা।মানুষের মধ্যে চেঞ্জ আসেই।সেটা
সময়ের ব্যাবধানে হোক বা পরিস্থিতির কারণে
হোক।
-আমি ঠিক বুঝতেছিনা তোমার কথা
-তুমি এখনো বুঝোনা?আচ্ছা তুমি এতো বোকা কেন?
তুমি বুঝোনা আমি কেন তোমাকে বারবার ফোন
দিতাম কেন তোমার ভার্সিটির সামনে যেতাম?
-টাকার জন্য
-গাড়ির লাইট ঠিক করতে পঞ্চাশ হাজার টাকা
লাগে?নিজেকে অনেক চালাক ভাবো অথচ তুমি
জানোওনা যে তুমি সবচেয়ে বড় গাধি।
-আমি গাধি?
-নাতো কি?গাধিইতো!তোমার মাথায় এটা আসেনাই
যে আমার এতো টাকা থাকতেও আমি টাকার জন্য
তোমার পিঁছে ঘুরবো কেন?
-কারণ তুমিতো কিপটা,তোমার কোন দয়ামায়া নেই
-আবার বাচ্চাদের মতো শুরু করলা।নাহ,তোমাকে আর
একটু বড় হতে হবে তারপর কথাটা বলবো।
-আরেহ না না,আমি বড় হয়েছিতো।তুমি বলো
-বলবো?
-হ্যাঁ বলো
.
আবিদ আমার হাত ধরলো।আমি ওর চোখের দিকে
তাকিয়ে আছি আর ও আমার চোখের দিকে।ওর
চোখের ভাষা এসব কি বলছে?নাকি আমি ভুল
ভাবছি?আবিদ আমাকে?ভাবতেই মনে হচ্ছে বুকের
ভেতর কিছু একটা খুব দ্রুত উঠানামাকরছে।আর
তাকাতে পারছিলাম না ওর চোখের দিকে।চোখ
সরিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম আমি।
-ভালোবাসি মীম
.
কথাটা শুনেই আবার বুকের ভেতর কেমন যেন করে
উঠলো।কিছুদিন ধরেই আবিদকে দেখলে বা ওর কথা
শুনলে বুকের ভেতর এইরকম অনুভূতি হয়। ধীরে ধীরে
আবিদের দিকে তাকালাম।ও সামনের দিকে
তাকিয়ে আছে।সম্ভবত ওকে দেখার জন্য আমাকে
সুযোগ করে দিয়েছে।আমি বুঝলাম ও এখন আবার
আমার দিকে তাকাবে তাই চোখ সরিয়ে নিলাম।
কেন জানি আমি চাচ্ছিলাম না যে আমাদের
চোখাচোখি হোক।ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো
-তোমাকে…মীম?
.
হুঁ করে জবাব দিলাম।তবুও আবিদের দিকে তাকানোর
সাহস পাচ্ছিলাম না।
-আই লাভ ইউ ।আই রিয়েলি লাভ ইউ মীম ।ভাবতেও
পারিনি তোমাকে এতোটা ভালোবেসে ফেলবো।
কেন জানি তোমার পাগলামী গুলো আমার ভালো
লাগতো।তোমাকে যে ভালোবাসি এটা বুঝতে
আমার অনেক সময় লেগেছিলো।কিন্তু তোমাকে
বুঝতে দেইনি।কারণ আমি চেয়েছি আমার জন্য
তোমার মনে আস্তে আস্তে ভালোলাগা গড়ে উঠুক
যেন এর স্থায়িত্ব আজীবনের জন্য হয়।হঠাৎ করে
তৈরী হওয়া ভালোলাগা বা ভালোবাসা যাই
বলিনা কেন তা হঠাৎ করেই আবার শেষ হয়ে যায়।
তোমাকে আরও আগে বললে হয়তোবা তুমি আমাকে
রাজীবের মতোই ভাবতে।ভাবতে যে তোমার প্রতি
আমার কোন ভালোবাসার ফিলিংস নেই কেবল
ফিজিক্যাল অ্যাট্রাকশন আছে।আমি বলছিনা
আমার সেটা কখনো হয়নি।আমি এও বুঝতে পেরেছি
যে তুমিও আমায় ভালোবাসতে শুরু করেছ।সো
তোমাকে কাছে পাওয়াটা আমার জন্য খুব কঠিন
কিছু ছিলোনা।কিন্তু সবথেকে বড় কথা কি জানো?
আমি মেয়েদেরকে শ্রদ্ধা করি।আর তোমার প্রতি
শ্রদ্ধা বোধ একটু বেশি থাকাই স্বাভাবিক।আমি
চেয়েছি তুমি আমাকে ভয় না পেয়ে আমার কাছে
নিজেকে নিরাপদ ভাবো।
.
চুপচাপ আবিদের কথাগুলো শুনছিলাম।কেন জানি
ইচ্ছে করছে ওর কথা গুলো চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস
করে ফেলি।বিশ্বাস করাটা কি ঠিক হবে?সত্যিই কি
ও আমাকে মন থেকে ভালোবাসে?আমার প্রতি
ভালোবাসা ছিলো বলেই টাকার বাহানা দিয়ে
আমার পিঁছে পিছে ঘুরতো?ওর কথাগুলো সব সত্যিই
মনে হচ্ছিলো।কি বলবো না বলবো তা নিয়ে
দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম।আবিদ আবার আমার হাত
ধরে একজোড়া চুড়ি পড়িয়ে দিলো।চুড়িগুলো দেখেই
আমি আবিদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।
এগুলো তো আমার মায়ের চুড়ি।আমার চোখ ছলছল
করছিলো।তাহলে আবিদ সত্যিই এতোদিন খেয়াল
করতো আমি কোথায় যাওয়া আসা করি!ওর
ভালোবাসায় আর কোন সন্দেহ রইলোনা।কিছু না
বলে আবিদের গলা জড়িয়ে হুহু করে কাঁদতে শুরু
করলাম।কিছুদিন আগে নতুন করে বাঁচার যে ইচ্ছে
জেগেছিলো তা মনে হচ্ছে আজ আরও বেড়ে গেছে।
আবিদকে নিয়েই বাঁচতে ইচ্ছে করছে।
.
পরদিন সকাল বেলা এরকম একটা ঘটনা ঘটবে
ভাবতেও পারিনি।ভালোবাসার আনন্দে সব চিন্তার
কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।আবিদের বাবা মা দুজনেই
বাসায় উপস্থিত হলেন।দুজনকেই খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে
আর আমি আর আবিদ অপরাধীর মতো দাড়িয়ে আছি।
আবিদের বাবা বললেন
-মেয়েটা কে?
-ও মীম।
-তোমার সাথে সম্পর্ক?(আবিদ আমার দিকে একবার
তাকালো)
-আমি ওকে ভালোবাসি।বিয়ে করবো ওকে।
.
আবিদের কথা শুনে ওর মা বসা থেকে উঠে আবিদের
বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
-দেখেছো আমি তোমাকে আগেই বলেছি যে এই
মেয়ের সাথে আবিদের সম্পর্ক আছে।কাজের মেয়ে
টেয়ে কিচ্ছুনা
.
আবিদের আম্মু এবার আমার দিকে এমন ভাবে
তাকাচ্ছে যেন আমি আসলেই এ বাড়ির কাজের
মেয়ে আর বাসন ধোঁয়ার সময় খুবই দামী একটা
কাচের প্লেট ভেঙে ফেলেছি।আবিদ আমাকে
বিয়ে করতে চায় এটা শোনার পর থেকেই উনি
আমাকে কাজের মেয়ের চোখেই দেখছেন।
-তুমি নাকি তোমার আম্মুকে বলেছো এই মেয়ে
তোমার বাসায় কাজ করে?
-হুমম বলেছিলাম।
-তাহলে আজ বলছো তাকে তুমি বিয়ে করতে চাও?
মিথ্যে বলেছিলে কেন?
.
আবিদ কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো।
আবিদের আব্বু আবার জিজ্ঞেস করলেন
-ওর ফ্যামিলিতে কে কে আছে?ওর বাবা কি করে?
-ওর বাবা গভর্নমেন্ট এমপ্লয় আর ওর মা কয়েকবছর
আগে মারা যায়।ঘরে এখন ওর সৎমা আর সেইঘরের দুই
ভাই আছে।
.
আবিদের কাছ থেকে আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে
শুনে ওর আম্মুর মেজাজ আরও গরম হয়ে উঠলো।
-শেষ মেশ একটা কাজের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়
তোমার ছেলে?আমি এই মেয়েকে কখনোই পুত্র বধু
হিসেবে মেনে নিবোনা।আবিদ,তুমি ওকে বিয়ে
করতে পারবানা।
-কেন পারবোনা?ওর সমস্যা কি জানতে পারি?
-কারণ ও আমাদের সোসাইটির সাথে মিলবেনা।যেই
মেয়ে বিয়ের আগেই একটা ছেলের সাথে একই
বাড়িতে থাকে সেই মেয়ে কেমন ফ্যামিলি থেকে
এসেছে তা বোঝাই যাচ্ছে।
-আম্মু তুমি ভুলে যাইয়োনা সেই মেয়েটা কিন্তু
তোমার ছেলের সাথেই ছিলো এই বাড়িতে।তাহলে
মীমের ফ্যামিলি আর আমার ফ্যামিলির মধ্যে তো
কোন তফাৎ দেখছিনা আমি।
-তুমি আমাদেরকে ইনসাল্ট করছো?একটা রাস্তার
মেয়ের জন্য তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বললে?
-মীম রাস্তার মেয়ে না,আম্মু।আজকে যদি আমি
তোমাদের লেভেলের বা তার চাইতেও উপরের
লেভেলের কোন মেয়েকে এই ঘরে নিয়ে আসতাম
তাহলে তো তোমরা তাকে রাস্তার মেয়ে না বলে
হাসিমুখে ঘরে ওয়েলকাম করতে।আর ও মিডেল
ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে হওয়াতে এটা তোমাদের
খারাপ লাগছে?তোমাদের অবহেলায় যখন এই পুরো
পৃথিবী আমার অসহ্য হয়ে গিয়েছিলো তখন এই
মেয়েটাই আমার বাঁচার পথ হয়ে দাড়ালো।এই
মেয়েটাই হয়ে উঠলো আমার হাসি, আমার সুখের
কারণ।আর সবচেয়ে সত্যি কথা কি জানো এই মিডেল
ক্লাস ফ্যামিলির মানুষ গুলো জানে কিভাবে
অন্যকে সুখে রাখতে হয়।
-তুমি যতো যাই বলোনা কেন আমি এই মেয়েকে
কিছুতেই মানবোনা।তুমি এই মেয়েকে বিয়ে করতে
পারবানা ব্যাস। রাস্তার সস্তা মেয়ে যত্তসব।
.
আর সহ্য করে থাকতে পারলাম না।ইচ্ছে করছিলো
আবিদের আম্মুকে কিছু বলি কিন্তু কোথা থেকে
যেন একটা বাঁধা অনুভব করলাম।হয়তো আবিদের
প্রতি ভালোবাসা আছে বলেই ওর মা বাবার সাথে
উঁচু স্বরে কিছু বলার দুঃসাহস দেখাতে পারছিলাম
না।সৃষ্টিকর্তা মনে হয় আবার আমার কাছে শত
অপমান,অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছেন।কিন্তু
সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় কিছু না বলে দ্রুত
পায়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।আবিদ
কয়েকবার ডেকেছিলো কিন্তু আমি সাড়া দেইনি।
আমার মতো আবিদও বুঝতে পেরেছে এখানেই হয়তো
সব শেষ।
.
বাসায় ফিরে গেলাম।ভেবেছিলাম আগের মতো
বাবা আর সৎমায়ের ভালো মেয়ে হয়ে থাকবো।আর
পাগলামী,দুষ্টুমি করবোনা।কিন্তু বাবা কিভাবে
যেন খবর পেয়ে গেলেন আমি আবিদের বাসায়
ছিলাম এতোদিন।তার উপর সৎমা টিপ্পনি কেটে
বলেছে "আমার ভাইপো কে বিয়ে করবেনা বলে
বাসা থেকে বেরিয়ে অন্য এক ছেলের সাথে
থেকেছে।নিজের বাবার মান সম্মানের কথা
ভাবলোওনা একটিবার।" যদিও বাবার খুব কষ্ট
হচ্ছিলো তবুও তিনি আমার কাছে এসে বললেন
"তোমার মতো মেয়ের দরকার নেই আমার।যে পথে
এসেছো সে পথ দিয়েই আবার বেরিয়ে যাও আমার
ঘর থেকে"
.
বুক ফেটে কান্না আসছিলো আমার।বাসা থেকে
বের হওয়ার সময় কেমন একটা পিঁছুটান অনুভব করলাম।
কিন্তু কিছুই করার ছিলোনা।আবার আমি একা হয়ে
গেলাম।
.
সন্ধ্যার পর সেদিনের মতো ল্যাম্পপোস্টের নিচে
রাখা ট্রলি ব্যাগটার উপর বসে আছি।মনে হলো কেউ
একজন আমার দিকে এগিয়ে আসছে।দেখেতো
আবিদই মনে হচ্ছে।কিছুটা কাছাকাছি আসায় বুঝতে
পারলাম এটা আবিদ আর ওর কাঁধে একটা ব্যাগ। -এইযে
ম্যাডাম,আপনি এখানে বসে আছেন কেন? -তুমি?
কাঁধে ব্যাগ কেন?তোমার গাড়ি কোথায়? -বাবা
বললেন তোমাকে বিয়ে করলে উনার
গাড়ি,বাড়ি,টাকা পয়সা সব ফেরত দিতে হবে।আর
মা বললেন ওই বাড়িতে তোমার কোন জায়গা
হবেনা।আমি ভাবলাম ও বাড়িতে থেকে কি করবো
আমি।তাই বেরিয়ে গেলাম,ভালো করেছিনা? -
উঁহু,খারাপ করেছো।ফিরে যাও তুমি।আমার সাথে
জড়ানো ঠিক হবেনা তোমার -আমার বিলাই আমারে
কয় মেয়াও!জ্ঞান দেয়া শিখছো কোত্থেকে? -
তোমার কাছ থেকেই তো . একে অন্যের হাত ধরে
অজানা গন্তব্যের দিকে হাটছি।দুজন মিলে
ভালোবাসার নতুন রাজ্য গড়ে তুলবো।পৃথিবীর যেই
প্রান্তেই যাইনা কেন,যতোদিন বাঁচিনা কেন মৃত্যু
পর্যন্ত এই মানুষটার হাত ধরে থাকতে রাজি আছি।এই
মানুষটাকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।
.
ক্ষুদ্র লেখক : Abm Abdullah ('চঞ্চলমতি' 'যোদ্ধা')