Saturday, September 2, 2017

--: স্বপ্নের বিপরীতে তুমি কিন্তু পুরোটা ভালবাসা :--

--: স্বপ্নের বিপরীতে তুমি কিন্তু পুরোটা ভালবাসা :--
:
......................দিশাহিন সুলতান
:
:
বাইরের দিকে তাকিয়ে অনবরত পা নাচাচ্ছে মাইশা। তার পা
নাচানোর কারণে টেবিলের উপর রাখা গ্লাসের পানি
কাঁপছে, আর তা দেখে অমিতের কলিজাটাও কাঁপছে। মাইশার
রিক্টারস্কেলে ১০ মাত্রার এমন কাঁপন দেখে তার ভাবি পায়ে
চিমটি কাটে।
-আউচ! ভাবি লাগছে তো।
-পা নাচাচ্ছিস কেন? দেখ ছেলেটা কিভাবে তাকিয়ে
আছে।
-এটা আমার অভ্যাস। জানো না মনে হয়! ছেলেকে
বাইরে তাকাতে বল।
কথা গুলো ফিশফিসিয়ে বললেও মাইশার ইচ্ছে করছে
জোরে চেচিয়ে চেচিয়ে বলতে, যাতে ছেলেটা
ভেগে যায়। কিন্তু সে পারছে না। দাদি বলেছে বিয়ের
কনেদের আসতে কথা বলতে হয়, লাজুক ভাব নিতে হয়।
কিন্তু লাজুক ভাবতো দুরের কথা মাইশা পুরো রাগি ভাব নিয়ে
বসে আছে। অমিতের দিকে এই প্রথম তাকাল মাইশা।
"সে কি! ছেলেটা স্পাইক করে আসছে কেন! বাবাটা যে
কি না! জানে আমি এমন গলা ছাঁটা মোরগ মার্কা ছেলে একদম
পছন্দ করিনা। তবুও কিভাবে পারলো? নামের সাথে চেহারার
কোন মিল নেই!" মনে মনে রাগে গরগর করতে থাকল
মাইশা। মাইশা আর অমিতকে কথা বলতে দিয়ে মাইশার ভাবি সরে
পরে।
অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতা! টেবিলে রাখা চিকেন ফ্রাইটার দিকে
একবার তাকাল মাইশা। তার খুব পছন্দের। কিন্তু আসার সময় দাদি
এও বলে দিয়েছে "বিয়ের কনেদের বরের সামনে
খেতে নেই। তোকে সাধলেও খাবি না" "উফ! দাদিটা যে
কি! সব কিছুতেই তার পুরনো খেয়াল। এখন সামনে বসা
মোরগটাকেই সহ্য করতে হবে"
- কিছু বললেন?
চমকে উঠে মাইশা! "ছেলেটা কিছু শুনেনি তো!"
-নাহ বলিনি।
-তা আপনি কিসে পড়ছেন?
-বাইও ডাটা দেখেন নি?
-হ্যাঁ দেখেছি তো।
-তো জিজ্ঞেস করছেন যে?
-না আসলে কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আপনার কিছু জানার আছে?
-আছে?
-জি বলুন
-আপনার নামের সাথে আপনার চেহারার মিল নেই কেন?
-কি রকম?
-এই যেমন নামটা অমিত, আর চেহারা বলছে আমার নাম রকি!
-হাহাহাহা! তা অমিতদের চেহারা কেমন হতে হয়?
-অমিতদের চেহারা হঠাৎ বৃষ্টি ছবির ফেরদৌসের মত হয় কিংবা
হুমায়ুন আহমেদের শুভ্রের মত হতে হয়।
-হাহাহা.......মজার তো!
-হুম আসলেই মজার
মাইশা আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তার জীবনটাই কেন যেন
মজার হয়ে গেছে। এই যেমন তার বাবা-মা খুব মজা নিয়ে
তাকে বিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে টেবিলে রাখা চিকেন
ফ্রাইটার মত মনে হচ্ছে তার। সবাই মজা নিয়ে খাচ্ছে আর
সে দেখছে।
আজ একটা বিরক্তিকর দিন গেছে মাইশার। অমিতকে পছন্দ না
হলেও বাবাকে বলেছে হয়েছে। কেন বলেছে তাও
জানে না। জানতে ইচ্ছেও করছে না তার, জানতে চাইলেই
হয়তো অমিতকে মেনে নেওয়া কষ্ট হবে। মাইশার একটু
নাক উঁচু স্বভাব আছে, জগতের কোন কিছুই যেন তার মত
করে হয়না। এই যেমন তার দাম্ভিক প্রকৃতির মানুষ পছন্দ অথচ
তার আশেপাশের মানুষগুলো সব কেমন জানি "দিলে বড়
জ্বালা" প্রকৃতির। সে নিশ্চিত অমিত ছেলেটাও এমন হবে।
ছেলেটার মধ্যে এখনো পিচ্চি পিচ্চি ভাব। সে হয়তো
কখনও বুঝবে না প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আইসক্রিম খাওয়ার মজা, অমিত
হয়তো বুঝবে না তপ্ত গরমে রবীন্দ্র সঙ্গীত
মুহূর্তেই সময়টাকে শীতল করে দিতে পারে, হয়তো
বুঝবে না বর্ষায় কোন একাকীত্ব নেই বরং হাজার হাজার
বৃষ্টির ফোঁটা বন্ধু হয়ে থাকে তোমার অজান্তে,
হয়তো......... মাইশার এসব ভাল লাগাকে সবাই উচ্চতর
পর্যায়ের পাগলামি ভাবে। মাইশার খুব ইচ্ছে করে ছাদের
রেলিং-এ পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে। কিন্তু একবার বসতে
গিয়ে যা কেলেঙ্কারি হল। তার দাদি ভেবে বসে সে
আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। সেই থেকে সে আর
বসে না। তার সব উদ্ভট ইচ্ছে গুলোর সাক্ষী হয়ে
থাকে একটা ডায়েরী।
ডায়েরীটার দিকে তাকিয়ে সে প্রায়ই ভাবে "এই
ডায়েরী ছাড়া হয়তো আর কেউ জন্মায়নি যে চোখের
ইশারাতেই বুঝে নিবে সব কিছু। যাকে ভালবাসি বলে চাপিয়ে
দেওয়া যাবে নিজের পাগলামি গুলো। ইশ! উপন্যাস পরে
আমার মাথা গেছে। সেই বিশেষ মানুষটা যে উপন্যাসের
নায়ক হতে হবে এমন তো কোথাও লিখা নেই" এসব
ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
মোবাইলে কলের শব্দে ঘোর কাটে মাইশার।
-হ্যালো!
-কেমন আছেন?
-কে বলছেন?
-আমি স্বপ্ন [হাসি]
-কিন্তু আমি তো জেগে আছি।
-আমি কি ঘুমের স্বপ্নের কথা বলেছি?
-ও আপনার নাম স্বপ্ন? তাহলে আমি দুঃখিত। এই নামে কাউকে
আমি চিনি না। রাখছি..........
-হ্যালো হ্যালো রাখবেন না প্লিজ। আমি অমিত।
-আমি জানতাম।
-কিভাবে?
-ভাবি আপনার নাম্বারটা মোবাইলে সেইভ করে দিয়েছিল
-তার মানে আপনি নিতে চান নি?
-মানে! ["এই ছেলে কিভাবে জানে এটা!"]
-মানে হল আমাদের মোবাইলে অন্য কেউ তখনি নাম্বার
সেইভ করে দেয় যখন আমরা নাম্বারটা নিতে চাই না, তাই না?
-আপনি তো বড়ই চালাক মানুষ।
-জি ["বোকা বউ পেলে সব পুরুষই চালাক হয়"]
-এক্সকিউজ মি! বিড়বিড় করে কি বললেন?
-না কিছু না। রাখছি ভাল থাকবেন। বিয়েতে দাওয়াত রইল।
মনের অজান্তে হেসে দেয় মাইশা। নিজেকে এমন
রূপে দেখে একটু অবাকই হল মাইশা।
এরই মধ্যে তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে যায়। গায়ে
হলুদের দিন। অমিত তাকিয়ে আছে মাইশার দিকে। সাদা শাড়ি আর
হলুদ পাড়ের একটা শাড়ি পরেছে। হলুদের সাঁজে নাকি
মেয়েদের অনেক সুন্দর লাগে। এতটা লাগবে অমিত
জানতো না। অমিতের খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে, এটা
তো আর সিনেমা না যে নায়ক প্রেমে পরল আর পরের
দৃশ্যেই গান শুরু হয়ে যাবে। নাহ গানটা মাইশাকে একাই
শুনাবে। যদিও হলুদের অনুষ্ঠানে গাওয়া যেত, কিন্তু এটা একটু
বিশেষ গান।
গানের আসরের আয়োজন চলছে। মাইশা এক পাশে
অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। হঠাৎ একটা মায়াবী ভরাট
কণ্ঠের গান মাইশার কানে ধাক্কা খেল।
"আমার ভেতর ও বাহিরে
অন্তরে অন্তরে আছ তুমি হৃদয় জুড়ে"
গায়কের দিকে তাকিয়ে মাইশা কি বলবে বুঝে উঠতে
পারেনি। অমিত তারই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গান গাইছে। এই
প্রথম মাইশা লজ্জা পেল। একদম আদর্শ নতুন বউয়ের
লজ্জা। তার স্বপ্নের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে এই
প্রথম ভাল লেগে উঠল। হয়তো তার প্রিয় গান গাওয়াতে,
কিংবা অন্যকিছু। আপাতত এই "অন্যকিছুর" কোন নাম দেওয়া যায়
না। বিয়েটা এত দ্রুত হয়ে গেল যে দুইজন দুইজনকে জানার
সময়টা পেল না। বিয়ের ঝামেলায় কেউ কাউকে খেয়ালি
করতে পারেনি এতদিন। বিয়ের দুইদিন পর। মাইশা, অমিত ও তার
বোন গল্প করছে। কিছুক্ষন পর অমিতের ছোট বোন
চিৎকার দিয়ে উঠে,
-ভাইয়া ভুমিকম্প!
-কই না তো।
-হ্যাঁ! বিছানা কেঁপে উঠল।
ততক্ষণে মাইশা পা নাচানো বন্ধ করে দিল। অমিত মাইশার
দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলছে, "হ্যাঁ রে।
রিক্টারস্কেলে মে বি ১০ মাত্রা হবে"
মাইশা আড় চোখে অমিতের দিকে তাকাল। তার খুব হাসি
পাচ্ছে। কিন্তু দমে আছে। কয়েকদিন যেতে না
যেতেই মাইশা লক্ষ্য করল অমিত তার খুব কেয়ার নিচ্ছে।
নতুন পরিবেশে মাইশা যাতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে
প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভাবে সেটা নিজ দায়িত্বে খেয়াল
রাখছে। মাইশাকে ভাবিয়ে তুলে, "এই ছেলেটা এমন
কিভাবে হতে পারে? আমি যেমন ভেবেছি তার বিপরীত।"
অনেকদিন পর ডায়েরীতে লিখতে বসে মাইশা। অমিত
আসার পর এই প্রথম লিখা। "ছেলেটাকে আজকাল বড্ড
বেশি ভাললাগে। একটু পিচ্চি তবুও। এই 'তবুও' র উপর নির্ভর
করে কোথাও হারিয়ে যেতে পারলে মন্দ হত কি? হ্যাঁ, ও
হয়তো চোখের ইশারায় সব বুঝবে না। আমি না হয় বুঝিয়ে
দিব। চোখ দিয়ে যদি সব হত উপর আলা তো আর মুখ
দিতেন না" লিখতে লিখতে সে খেয়াল করল সব কিছুতেই
তার এই পিচ্চি বরটা চলে আসছে। আর লিখার সাহস পাচ্ছে না।
ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছে মাইশা। পেছনে অমিত এসে
দাঁড়ালো।
-কি আমার কথা ভাবছ? হিহি
-না তো। তুমি কি ভাবার বিষয়?
-আমি স্বপ্নের বিষয় না হলেও ভাবার বিষয়। হিহি
-হাসি ছাড়া তুমি কথা বলতে পার না?
-নাহ একদম না। তুমি হাসো না বলে কি আমিও হাসব না? দুইজনই
মুখ গোমরা করে রাখলে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তার উপর
কোন অঘটন ঘটলে দেনমোহর তো আমাকেই দিতে
হবে তাই না? হিহি
মাইশাকে অমিত অবাক করেই চলেছে। হয়তো রুপকথার
রাজপুত্রের মত নয়, ডায়েরির পাতায় লুকিয়ে থাকা সেই
কেউ একজনের মত।
-মাইশা, তোমার নিশ্চয়ই এখন ছাদের রেলিং এ পা ঝুলিয়ে
বসতে ইচ্ছে করছে?
এবার মাইশা আকাশ থেকে মাটিতে না পরে, মাটি থেকে
যেন আকাশে উঠে পরেছে। কারণ মধ্যাকর্ষণ শক্তির
বিপরীতে আকাশে উঠাটাই সব চেয়ে অবাক করার মত কিছু।
- তুমি কিভাবে জানো?
-ম্যাজিক বুঝলে ম্যাজিক!
-তুমি কিছু লুকাচ্ছ!
অমিত পেছনে লুকিয়ে রাখা একটা জিনিস বের করল।
-আমার ডায়েরী! এটা কোথায় পেলে? আমাকে দিয়ে
দাও।
-নাহ দিব না। একটা কলম ৫ টাকা বুঝলে? কলম নষ্ট করে
ডায়েরিতে না লিখে আমাকে বলা যায় না?
-অমিত! আমার ডায়েরী দাও।
অমিত নিষ্পাপ চেহারায় ডায়েরী দিতে দিতে বলে, "আচ্ছা
এই তবুওর উপর নির্ভর করে কোথাও না হারাও কিন্তু কিছুক্ষণ
পাশে বসে থাকা যায় কি?"
-আমার সব উদ্ভট বায়নার ধারক হবে তো?
মাথা চুলকাতে চুলকাতে অমিত বলল, " আর যাই কর, ছাদের
রেলিং এ বসতে বল না প্লিজ। হিহি"
-পিচ্চি!
খোলা ছাদে বসে আছে দুই জন, মেঘলা আকাশ আর?
আর সেই বাকি থাকা গানটা-
"বধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে
নীল আকাশ থেকে একি বাজ এনেছে হায় বিনা কারণে
দিনে দিনে মূল্য বিনে
সে যে আমায় নিলো কিনে"
--------------------- সমাপ্ত ---------------------

No comments:

Post a Comment