Monday, June 26, 2017

গল্প: "ভাগাভাগি"

# ইদ_স্পেশাল_গল্প
.
গল্প: "ভাগাভাগি"
.
.
এক
শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে টেবে হলুদ
রংয়ের শাড়িটাই কিনে নিল সজীব। যদিও লালটাই বেশি
ভালো লেগেছে তার। কিন্তু ওটার দাম একটু না,
অনেক বেশি। এতোটাই বেশি যে, সজীবের
সাধ্যের বাইরে। দোকানি কে যখন সজীব একবার
বলেছিল,
"ভাই, কম রাখা যায়না?"
দোকানি তাকে হতাশ করে খুব সুন্দর করেই বলে
দিয়েছে,
"সরি ভাইয়া। fixed price. আপনি এগুলোর মধ্যে
দেখতে পারেন। কমের মধ্যে আছে।"
বলেই সজীবের দিকে কিছু নর্মাল সুতির শাড়ি
এগিয়ে দিল। সজীব কিছুক্ষন দোকানির দিকে
তাকিয়ে রইল। এই মানুষ গুলো বোধহয় ক্রেতা
দেখলেই বুঝে যায়, অর্থনৈতিক ভাবে কে কোন
শ্রেণির। তারপর একবার দোকানির দেওয়া শাড়ি
গুলোর দিকে তাকিয়ে আবার তাকালো সেই লাল
শাড়িটার দিকে। সবার চোখই ভালো জিনিস টার উপরই
যায়। কেউ হয়ত সামর্থ্য থাকেনা বলে পছন্দের
মানুষটার জন্য পছন্দের জিনিসটা নিতে পারেনা।
সজীবও নিতে পারছেনা। খুব নিখুঁত ভাবে কাজ করা
লাল শাড়িটার দিকে তাকিয়েই রইল সে। মনেমনে দুই
মিনিট কল্পনা ও করে নিল সজীব। লাল শাড়িতে
মিতুকে একদম লাল টুকটুকে নতুন বৌ এর মত লাগবে।
মনে হবে যেন, সদ্য বিয়ে হওয়া নতুন বৌ। হলুদ রং
টাতেও ভালো লাগবে। কিন্তু মিতুর পছন্দ হবে
তো? মেয়েরা হলুদ রং খুব একটা পছন্দ করেনা
বললেই চলে। মিতুও হয়ত নাক তুলে বলবে,
"ছি হলুদ রং কেউ পরে নাকি?"
বিয়ের পর এই প্রথম ইদ। প্রথম বারেও যদি তার
পছন্দ মত শাড়ি না দিতে পারে, মনের মধ্যে একটা
খুঁত খুঁত ভাব রয়েই যাবে সজীবের। কিন্তু কিছুই
করার নাই। হলুদ শাড়িটাই নিল সে। সবাই পছন্দের জিনিস
নিতে পারেনা। সবার জন্য সবকিছু না। আর তার উপর
মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ গুলোর তো জীবন টা
যায়ই বিসর্জন দিতে দিতে। আহ্লাদ করে ভালোলাগা
কিছু হুট করেই দেওয়া যায়না ভালোলাগার মানুষ
টাকে। মাঝেমাঝে তো ভালোলাগা সেই মানুষ
টাকেই বিসর্জন দিতে হয়।
কলেজ জীবনে একটা মেয়েকে খুব ভালো
লাগতো সজীবের। ভালোবাসতো কিনা সে আদৌ
জানেনা। কিন্তু ধনীর দুলালী মেয়েটি যখন
ক্লাসে একগাদা ছাত্রছাত্রীর সামনে সজীবের
দেওয়া চিঠি টা পড়ে শুনায়, সেদিন সজীব খুব
অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছিল। জীবনের প্রথম
কাউকে প্রেম পত্র দিয়েছে। তাও আবার এইভাবে
অপমানিত হবে সে ভাবেনি। চিঠিটা সবাইকে চিল্লিয়ে
চিল্লিয়ে পড়ে শুনিয়েও মেয়েটা ক্ষান্ত হয়নি।
সজীবের সামনে এসে চিঠিটা ছিড়ে ফেলেছে
সে। আর বলেছিল,
"সমশ্রেণীর কাউকে বেছে নিলেই পারতে।
অন্তত অপমানিত হতে হত না।"
সজীব সেদিন নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল শুধু। কিচ্ছু
বলতে পারেনি। আসলেই তার একবার ভাবা উচিৎ ছিল।
সেদিনই সজীব বুঝেছিল, জীবন টা কোনো
বাংলা সিনেমা না। কোনো রোমান্টিক স্টোরি
পেইজ এর গল্প না যে; হাজার,লক্ষ বাধা বিপত্তি
অতিক্রম করার পর সেই ধনীর দুলালি মেয়েটি আর
মধ্যবিত্ত বেকার ছেলেটির মিল হবেই।
জীবনের এই পর্যায়ে এসে সজীবের অবশ্য
মনে হয় যে, সেদিন মেয়েটি তাকে রিজেক্ট
করে ভালোই করেছে। নতুবা সম্পর্ক টা
কখনোই টিকতো না। টিকলেও হয়ত মেয়েটার
চাহিদা থাকতো হাজার টাকার শাড়ি আর প্রসাধনী।
যেখানে চাল, ডাল, কিনার পর বছরে একবার সুতির
একটা শাড়ি দিতেও হিমশিম খেয়ে যায় সজীব।
তারচেয়ে বরং সমশ্রেণীর একজন কে নিয়েই
সে ভালো আছে। অনেক ভালো আছে। মা,
ছোট বোন আর মিতু কে নিয়েই সে যথেষ্ট
সুখি।মেয়েটা ও তার মতই মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে।
জীবনের কঠিন বাস্তবতা সেও বাবার পরিবারে
থাকতেই বুঝেছে। তাইতো সজীবের এই
টানাটানির সংসার টা মোটামোটি ভালো ভাবেই চালিয়ে
নেয় সে। সবচেয়ে সুখি হয়ত কেউই হয়না। কিন্তু
সজীব নিজেকে সুখি মনে করে। যদিও
মাঝেমাঝে প্রিয় মানুষ গুলোকে আলাদা করে কিছু
দিতে পারেনা বলে খুব খারাপ লাগে, কিন্তু যখনই
দেখে মানুষ গুলো তার এই ছোট্ট ছোট্ট
দেওয়া জিনিস গুলোতেই তৃপ্ত, তখন নিজেকে
সুখি মানুষ দের তালিকায় প্রথমেই রাখতে ইচ্ছে
করে।
.
দুই
ছেলের ডাকে রাহেলা বেগম নামাজের জায়নামাজ
টা রেখে বেরিয়ে আসলেন নিজের ঘর
থেকে। পড়ার টেবিল থেকে তিতলি ও দৌড়ে
এসেছে ভাইয়ের ডাক শুনে। আসলো না শুধু মিতু।
রান্নাঘরে চ্যাঁত চ্যাঁত শব্দ করে পেঁয়াজু ভাজছে
সে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সজীব,
-মিতু কোথায়, মা?
-রান্নাঘরে। কেন?
-ডাকো।
রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো মিতু। কিছুক্ষন তার
ঘর্মাক্ত, ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সজীব।
তারপর চোখ সরিয়ে ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি
এগিয়ে দিল মায়ের দিকে। বলল,
-মা, এটা তোমার জন্য।
রাহেলা বেগম ঝাপসা চোখে ছেলের দিকে
তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। ছেলের হাত
থেকে শাড়ির প্যাকেট টা হাতে নিলেন শুধু। এবার
সজীব তিতলি কে একটা ব্যাগ দিয়ে বলল,
-নে বুড়ি এটা তোর।
ভাইয়ের হাত থেকে ব্যাগ টা নিয়েই খোলার জন্য
ব্যস্ত হয়ে পড়ল বারো বছরের তিতলি। হাতের
বাকি প্যাকেট টা নিয়ে আস্তে আস্তে মিতুর কাছে
এসে দাঁড়ালো সজীব। মিতুর দিকে সেটা বাড়িয়ে
দিয়ে বলল,
-এটা তোমার জন্য। পছন্দ হবে কিনা জানিনা।
মিতু কিছু বলল না। সজীবের হাত থেকে প্যাকেট
টা নিয়ে চলে আসলো। একবার খুলেও দেখলো
না। প্যাকেট টা খাটের উপর রেখে সে আবার
চলে গেল রান্নাঘরে। মন টা খারাপ হয়ে গেল
সজীবের। মিতু কে সাথে করে নিয়ে গেলেই
পারতো। নিজের পছন্দ মত কিনতো একটা শাড়ি।
.
তিন
রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখে মিতু আগেই ঘুমিয়ে
গেছে। মেয়েটা আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে
পড়লো কেন? চাপা একটা কষ্টে ধক করে
উঠলো সজীবের ভেতরটা। একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলল সে। বালিশ টা নামিয়ে শুতে যাবে তখনই পাশ
থেকে উঠে গেল মিতু। তারপর ড্রয়ার থেকে
সেই হলুদ শাড়ির প্যাকেট টা আর সাথে আরো
একটা প্যাকেট নিয়ে সজীবের সামনে রাখলো
সে। ঘটনার আকস্মিকতায় অবাকই হল সজীব। শোয়া
থেকে উঠে, মিতু কে জিজ্ঞেস করল,
"কী এগুলো?"
সজীবের প্রশ্নের জবাব দিলনা মিতু। সে বলতে
শুরু করল,
-জানো সজীব? ছোট বেলা থেকেই বাবাকে
দেখতাম প্রতিবছর ইদে আমাদের তিন বোন আর
মায়ের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনে আনতেন।
হোক না সেটা সস্তা কিংবা কটকটে রঙের,
আমাদের তিন বোনের খুশি দেখে কে? কিন্তু
বাবা কখনো নিজের জন্য কিছু কিনতেন না। বাবাকে
যখন জিজ্ঞেস করতাম, "বাবা তোমার নতুন জামা কই?"
বাবা তখন হাসিমুখে বলতেন, "বড়দের নতুন জামা
কিনতে নেই মা।" বাবার এই মিথ্যে কথা টি সেদিন
আমরা কোনো কারন ছাড়াই বিশ্বাস করেছি। কিন্তু
ধীরে ধীরে বাস্তবতার বেড়াজালে আবদ্ধ
হয়ে আমি বুঝতে পারি বাবা সেদিন মিথ্যে বলেছিল।
শুধু সেদিনই না, প্রতিনিয়তই আমাদের সাথে মিথ্যে
বলছেন। "আমার এটা লাগবে না, ওটা লাগবে না" এসব
বলে বলে পাশ কাটিয়ে যেতেন। তারপর একবছর
টিফিনের টাকা, স্কুলের উপবৃত্তির টাকা বাঁচিয়ে বাবার
জন্য একটা পাঞ্জাবী আর সস্তা একটা লুঙ্গী
কিনে দিয়েছি। বাবা এগুলো দেখে ধমক
দিয়েছেন সেদিন। তারপর আর তাকে দিই নি। মাটির
ব্যাংকে জমাতাম, আর যখনই কোনো বিপদ হত মা
তখনই টাকা গুলো কাজে লাগাতেন। খুব ভালো
লাগতো তখন। জানো সজীব? বাজার থেকে
ফেরার সময় বাবা ভারী ব্যাগ টা নিয়ে হেঁটে
হেঁটেই বাড়ি আসতেন। কেন জানো? পরিবারের
মানুষ গুলো কে সুখি করতে।
.
এইটুকু বলেই থামলো মিতু। কিছুক্ষন নিচের দিকে
তাকিয়ে চুপ করে রইল। মনে হচ্ছে যেন বিশ্রাম
নিচ্ছে।
খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সজীব। এবং একটু
পরই আবিষ্কার করল, মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কাঁদছে। দ্বিতীয় বারের মত মিতু কে কাঁদতে
দেখছে সজীব। প্রথম দেখেছে, যেদিন
মিতুর বাবা মিতু কে তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল,
-আমি বলব না, "আমার মেয়েটা অবুঝ। কিংবা ধনীরর
দুলালী। কিচ্ছু পারেনা।" শুধু এইটুকু বলব, "ওকে
আমি কখনো কাঁদতে দিইনি। আল্লাহর উপর ভরসা
করে তোমার হাতে তাকে তুলে দিলাম। ওকে তিল
পরিমাণ কষ্ট দিলেও মনে করবে একজন পিতার
অন্তরে এসে বিঁধবে সেটা।
সেদিন খুব জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদেছিল মিতু।
খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিল তার বাবা কে। আর
আজ মিতু কাঁদছে নিঃশব্দে। আচ্ছা ও কাঁদছে কেন?
সজীবের কোনো ব্যাবহারে কী কষ্ট
পেয়েছে সে? সজীবের খুব জানতে ইচ্ছে
করছে, মিতুর এই নিশ্চুপ কান্নার আওয়াজ কী তার
বাবার অন্তরে গিয়ে সত্যি সত্যিই বিঁধছে? সজীব
মিতুর চিবুক ধরে উপরে উঠালো। খুব নরম স্বরে
ডাকলো,
-মিতু?
-হুম
-কাঁদছো কেন?
-আমার খুব কষ্ট হচ্ছে সজীব।
-কিসের কষ্ট?
-আমরা মেয়েরা খুব খারাপ তাইনা? পুরুষের কষ্ট টা
কখনোই বুঝিনা। "Sacrifice" শব্দ টা শুধু তোমাদের
জন্যই। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাড় ভাঙা
পরিশ্রম করেও তোমাদের শুনতে হয় "এটা
আনোনি কেন?, ওটা আনোনি কেন?" আমরা
মেয়েরা খুব লোভী তাইনা সজীব? নিজের টা
ঠিকমতোই আদায় করে নি। তোমাদের কথা
একবারো ভাবিনা। আর তাই তোমরাও মেয়ে জাতি
টাকে সেইভাবে দেখে আসছো। কখনো
বুঝতে পারো না যে, মেয়েরা ও চায় তোমাদের
সুখ দুঃখের ভাগীদার হতে।
সজীব চুপচাপ মিতুর দিকে তাকিয়েই আছে। এই
মেয়েটা যে এতো কথা বলতে পারে
সজীবের জানা ছিলনা।
-এসব কেন বলছ মিতু?
-জানিনা। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে "নারী" এই
শব্দ টাকে তোমরা পৃথিবীর সবচেয়ে লোভী
মনে কর।
-যদি তাই হত, তবে "মা", "বোন" এই শব্দ গুলো
থাকতো না। তুমি কেন বলছ এসব?
-আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলবে?
-হুম
-মা, আমি, আর তিতলি ছাড়া অন্য যেকোন
মেয়েকে তোমার কখনো খারাপ মনে হয়নি?
-মিতু, আমার কাছে পৃথিবীর সেরা তিনজন নারী হচ্ছ
তোমরা। তোমাদের সাথে কারো তুলনাই আমি
কখনো করতে পারবো না।
-সব মেয়েই কারো না কারো মা, কারো স্ত্রী,
কারো বোন।
-জানি। কিন্তু তুমি আমাকে এসব বলছ কেন?
-সরি সজীব। আমি আসলে তোমাকে এটা বুঝাতে
চাইনি। অন্য একটা বিষয় বুঝাতে চেয়েছি।
-তুমি কী বলতে চাইছ, সেটা বল।
-সজীব, তুমি কী জানো? বছরের এই একটা
ইদেও তোমার জন্য কিছু না কিনা তোমার মা,
বোনের জন্য কতটা কষ্টের। আমি তো এসেছি
মাত্র কয়েক টা মাস। সবার কথা বাদ। মায়ের কথা টা
তো ভাববে একবার।
সজীব কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
-আমার আসলে ভালো লাগেনা। তাই কিনি না।
-তুমি কী মনে কর? সাজিয়ে গুছিয়ে শুধু তোমরা
পুরুষ রাই মিথ্যে বলতে পারো। আমরা পারিনা?
সজীব, তোমার যেমন প্রিয় মানুষ গুলো কে
ভালো কিছু না হোক, সামান্য কিছু দিতে মন চায়।
তেমনি সেই মানুষ গুলোর ও খুব ইচ্ছা হয়
তোমাকে কিছু দিতে, পরাতে।
-তুমি ভুল ভাবছো মিতু। আমি এমনিতেই কিনি নি।
-হুম জানি। এই প্যাকেট টা খুলবে একটু?
বলেই একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল সজীবের
দিকে।
-কী এটা?
-খুলেই দেখো না।
প্যাকেট টা খুলল সজীব। হালকা বাদামী রঙের
একটা পাঞ্জাবী। সজীব অবাক হয়েই জিজ্ঞেস
করল,
-কার এটা?
-আগে বল কেমন?
-হুম সুন্দর।
-শুধুই সুন্দর?
-নাহ
-তো?
-একদম তোমার মত সুন্দর। এবার বল কার?
-আমার বরের।
-মানে?
-তিতলি আমাকে বলেছে, তুমি কখনোই নিজের
জন্য কিছু কিন না। তাই সেদিন ওর সাথে গিয়ে
কিনেছি এটা।
-টাকা পেলে কোথায়?
-মেরেছি।
-মানে?
-প্রতিদিনের চালের টাকা, ডালের টাকা থেকে।
সজীব কিছু বলল না। মিষ্টি করে একটা হাসি দিল।
ছেলেদের হাসি ও এতো মিষ্টি হয় নাকি? হঠাৎ মিতুর
দিকে তাকিয়ে বলল,
-মিতু?
-হুম
-শাড়ি পছন্দ হয়েছে?
-না হলে কী করবে?
-বল না। হয়েছে?
-দেখে বলি?
-দেখোনি এখনো?
-না। এখন দেখব।
শাড়ির প্যাকেট টা খুলল মিতু। কটকটে হলুদ রঙের
সুতির একটা শাড়ি। পরম তৃপ্তি নিয়ে মিতু তাকিয়ে আছে
শাড়িটার দিকে। তার স্বামীর পরিশ্রম করে রোজগার
করা টাকা দিয়ে কেনা শাড়ি টা। মিতুর কেন জানি মনে
হচ্ছে, সজীবের ঘাম লেগে আছে শাড়ি টা তে।
-কেমন?
-উহু সুন্দর না।
-কেন?
-পাঞ্জাবী টা আমার মত সুন্দর হলেও শাড়ি টা কিন্তু
আমার বরের মত সুন্দর না। আমার বর আরো কিউট।
-তাই?
-হুম
দুজনেই চুপ। কেউই কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে
যেন তারা সুখ পালন করছে। আচ্ছা শোকে মানুষ
নীরবতা পালন করে। সুখে ও কী করে? কী
জানি। করে হয়ত। সম্বিৎ ফিরলো মুঠোফোনের
শব্দে। ফোন টা হাতে নিয়ে উঠে গেল
সজীব। প্রায় দশ মিনিট পর ফোনালাপ শেষ করে
ফিরে আসলো সে। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-বাবা ফোন দিয়েছে।
-বাবা?
-হুম। নিয়ম আছে নাকি, বিয়ের পর মেয়ের শশুর
বাড়ির লোকদের কে ইদে জামা-কাপড় দিতে হয়।
কেনাকাটার সময় পাননি, তাই টাকা পাঠাতে চাচ্ছেন। বিকাশ
নাম্বার চাচ্ছেন।
নিমিষেই মন টা খারাপ হয়ে গেল মিতুর। মেয়েকে
বিয়ে দিয়েও পার পায়নি তার বাবা টা। বাড়তি খরচ সব।
কীজানি হয়ত সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না
কিনেই টাকা টা যোগাড় করতে হয়েছে তার। চাপা
একটা নিশ্বাস নিয়ে মিতু বলল,
-নাম্বার দিয়েছ?
-না।
-কেন?
-বলেছি, ঐ টাকা দিয়ে যদি এখন গিয়ে তাদের সবার
জন্য কেনাকাটা না করে, তবে তার মেয়ে কষ্ট
পাবে। খুব কষ্ট পাবে। আর সে কষ্ট পেলে
ওনার ছেলের অন্তরে বিঁধবে।
-সত্যি?
-হুম, সত্যি।
-কিনবে?
-কিনবে। কারন আমাকে কথা দিয়েছেন।
.
একটা প্রশান্তিরর হাসি দিল মিতু। বিয়ের আগে "শশুর
বাড়ি" শব্দ টাকে খাদক মনে হত তার। কিন্তু এই
পরিবারের মানুষ গুলো তার ধারনা পাল্টে দিয়েছে।
সজীবের মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে সজীব কে
ডাকলো মিতু,
-সজীব?
-হুম
-একটা কথা রাখবে?
-কী?
-আজ থেকে তোমার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবকিছু
ভাগাভাগি করবে আমার সাথে, বল।
-সব?
-হুম সব।
-করব। তুমিও করবে।
-কী?
-আমার সাথে ভাগাভাগি করবে।
-করব। তুমি আমার সাথে, আর আমি তোমার সাথে।
ঠিক তো?
-হ্যাঁ, ঠিক।
-এবার ঘুমাও। কাল সকালে অনেক কাজ। ভোরে
উঠতে হবে।
সজীব কিছু বলল না। শুধু পরম তৃপ্তির একটা হাসি দিয়ে
শুয়ে পড়লো।
.
গভীর রাত। দুটি মানুষ পাশাপাশি ঘুমাচ্ছে। ঘুমের
ঘোরেই হয়ত তাদের দুজনের দুটি হাত এক হয়ে
আছে। মাত্র কয়েক মাস আগেও কেউ কাউকে
চিনতো না। দুজনই ছিল দুজনের কাছে অপরিচিত
একজন মানুষ মাত্র। বিধাতার কি অপার মহিমা!
অচেনা,অজানা মানুষ দুটি আজ পরস্পর কত আপন। কত
আপন এই দুটি পরিবার। কত ভালোবাসা। কত সুখি তারা।
পৃথিবীর সুখি মানুষদের তালিকায় এই মানুষ দুটি নির্দ্বিধায়
তাদের নামটা প্রথমেই দিতে পারবে।
.
কাল পবিত্র ইদ। ইদুল ফিতর। বছরের এই একটা দিনে
যেন মুসলিম পরিবার গুলোতে খুশির বন্যা বয়ে যায়।
হোক না অর্থনৈতিক কিছু টানাপোড়ন। তাতে কী?
ইদ তো ইদই। এটাতো সার্বজনীন।
সুখ জিনিসটা নিতান্তই আপেক্ষিক।
চাইলেই হাজার অভাব আর সীমাবদ্ধতার মাঝেও তুমি
সুখি হতে পারবে।তার জন্য শুধু প্রয়োজন তোমার
পাশে থাকা কিছু মানুষ। আর তাদের হাত। যেন চরম
কঠিনতম দিন গুলোতেও তোমাকে ছাড়বে না।
তোমার সামান্য একটা সুতির শাড়িতে যে খুব
আহ্লাদী হয়ে সেটা গ্রহণ করবে। নতুবা,
প্রতিদিনের বাজার খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে
সস্তা একটা পাঞ্জাবী পেয়েই নিজের জীবন টা
কে স্বার্থক মনে করবে।
.
পরিশেষে, ভালো কাটুক প্রত্যেক টা মানুষের ইদ।
ভালোবাসার মানুষ গুলোর সাথেই কাটুক পবিত্র এই
দিন টি। ইদের আনন্দ নয় শুধু, প্রতিটা দিনের আনন্দ
গুলো ভাগাভাগি করেই বেঁচে থাকুক সবাই।
সবাইকে ইদের শুভেচ্ছা।
ইদ মোবারক।
.
লিখা: মৃত্তিকা(সেই মেয়েটি)
.
Ummay Ayesha Siddikap

No comments:

Post a Comment