Tuesday, July 25, 2017

গল্প : ল্যান্ডফোন

গল্প : ল্যান্ডফোন

আপনার নীল রং ভাল লাগে?
- উহু। কালো।
- কেমন মিল দেখুন! আমারো কালো।
- মিথ্যে বলছেন কেন? কালো কি
কারো পছন্দের রং হয়?
- তবে যে আপনার হলো?
- আমার হল বলে বুঝি আপনারো হতে
হবে?
- আশ্চর্য তো। কে বলেছে আপনার প্রিয়
বলে আমার প্রিয় রং কালো?
উত্তরদাতার পাল্টা প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত
চুপ হয়ে যায় মেয়েটি সেকেন্ড দশেক।
অপর প্রান্তের ছেলেটি এ প্রান্তের
কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বলে উঠে,
-স্যরি!!
-কেন?
- এইযে আপনি রাগ করলেন?
- মোটেও না। অভিমানের সুর লুকানোর
আপ্রান চেষ্টা মেয়েটির।
- সত্যি?
-হুম। রাগ করলে আর আপনার সাথে আর
কথাই বলতাম না।রিসিভার টা রেখে
দিয়ে দিতাম সারা জীবনের জন্য।
কোন কালেই আপনার ফোন আর ধরতাম
না!
-বাব্বাহ! এতো রাগ? রাগলে আর কি
কি করেন আপনি?
- যার উপর রাগ করি তার মুখের দিকে
তাকাতে পারি না।
-বুঝলাম। ছেলেটি আর কথা বাড়ায়
না। কে জানে! মেয়েটি যখন জানবে
ছেলেটিরও অভিমান হলে
কারোপ্রতি তাকাতে পারেনা তখন
হয়তো আবারও অবিশ্বাস করবে!!
গল্পটির শুরু হয়েছিল যখন গ্রীষ্মকাল
আসি আসি । আগের দিনও মেয়েটির
বাসার ল্যান্ডফোনে ফোন
এসেছিলঅনেকবার। কিন্তু এ পাশ হতে
সারাদিনেও কেউ উত্তর দেয়নি!
পরদিন ভাতঘুমের দুপুরে মেয়েটি যখন
তার বারান্দায় বসে আপন মনে কথা
বলছিল, তখন আবারো এল ফোন কলটি।
- হ্যালো?
- কি ব্যাপার বলুন তো? ল্যান্ড ফোনটি
কি আসলেই কাজের জন্য না বাসার
সৌন্দর্য বাড়াতে কিনেছিলেন?
প্রশ্ন কর্তার বলার ভঙ্গিতে কেমন
জানি হকচকিয়ে যায় মেয়েটি।
অস্ফুটো স্বরে বলে,
-কেন?
- কাল হতে চেষ্টা করছি ফোন
দেওয়ার। কারো কোন সাড়া শব্দ নেই!
টেলিফোনটি যদি জড় না হতো তবে
নির্ঘাত বিরক্ত হে নিজেইকথাবলে
উঠত !!
ছেলেটির অভিযোগ আর বিরক্তিতে
ব্যাঘাত ঘটিয়ে অপর প্রান্তে
কয়েকগাছি কাচের চুড়ি ভাঙ্গার
শব্দহলো! ভুল শুনলো কি? না। ছেলেটি
আবার কান খাড়া করে, মেয়েটির
হাসি ঠিক যেন কাচের চুড়ির আওয়াজ!
- কাকে চাই?
প্রশ্নটি শুনে এবার ছেলেটিই
ভ্যাবাচেকা খেল। গুছিয়ে
রাখাশব্দগুলো এই মুহূর্তে বড্ড
এলোমেলো!
- এটা কি হাসান স্যারের নাম্বার?
- না।
- তাহলে নিশ্চয় তমালিকা
ম্যাডামের?
- না। আপনার কোথায়ও ভুল হচ্ছে।
রাখি।
-শুনুন। আপনার নামটি কি জানতে
পারি?
চুপ হয়ে যায় মেয়েটি।
- আপনি আসলে কাকে চাচ্ছেন বলুন
তো? হাসান স্যার? তমালিকা
ম্যাডাম? নাকি অন্য কাউকে?
- যাকে চাচ্ছি তার নামটি ভুলে
গিয়েছি!!
শহরতলীর এক প্রান্তে মেয়েটির
বাসা। বাবা আর মেয়ের সংসার।
আলাভোলা বাবার উদাসীন মেয়ে
সে। মধ্যদুপুরে পুকুর ঘাটে বিশ্রাম
নেওয়া রাজহাঁসটা অথবা ভাঙ্গা
ভেন্টিলেটরে বাসা বাধাঁ শালিক
পাখির সংসারের সাথে তার বড়ো
ভাব।সেই ভাবে ব্যাঘাত ঘটায়
ল্যান্ডফোন!
মেয়েটির বাসার ল্যান্ড ফোনে হরদম
এরকম রং নাম্বারে ফোন আসে।কখনো
অলস দুপুরে, কখনো বিষন্ন শেষ বিকেলে,
এক দিন তো কাকডাকা ভোর বেলায়
এসেছিল রং নাম্বারের ফোন।
- হ্যালো, এটা কি সুদীপার নাম্বার?
- নাহ।আর শুনুন, এটা কিন্তু হাসান স্যার
আর তমালিকা ম্যাডামেরও নাম্বার
না!!
ধরা পড়ে অপর প্রান্তের মানুষটি চুপ
হয়ে যায় কয়েক মুহূর্ত!
- আমি কিন্তু আজ আসল মানুষটাকেই
চাচ্ছি। সুদীপা।
মেয়েটির বোধ হয় অভিমান হলো।
- স্যরি। এখানে সুদীপা বলে কেউ
থাকে না।
ছেলেটি নাছোড়বান্দা।
- মিথ্যে বলছেন কেন? আমি জানি,
আপনিই সুদীপা!
- বাব্বাহ!! তাহলে তো এতদিন নিজের
নামটাই ভুল জেনে আসছি!
মেয়েটির ভৎসর্না ছেলেটি কানে
নেয় না।
- মিথ্যে কথা বলে কি লাভ বলুন?
- আমি মিথ্যে বলছি না। আপনার
কোথায়ও ভুল হচ্ছে।
- মোটেও না। রং নাম্বারে ফোন
দেওয়ার মত এরকম ভুল আমার হয় না।
ছেলেটা তারপর হতে প্রায় ফোন দিত।
রোজ যদিও না। রিসিভার কানে তুলে
মেয়েটি শব্দ বুনতো। রাজহাঁস আর
শালিক পাখির যে প্রশ্নগুলোর উত্তর
জানা ছিল না, ছেলেটি সেই প্রশ্নের
উত্তর দিতো।শব্দেরা মালা গাঁথে।
কথার পিঠে কথা হয়।
- জানেন, আমার বাড়ির পশ্চিমের
বারান্দা ছোঁয়া একটা জারুল আর
একটা সোনালী সোনালুর গাছ।
বেগুনরঙা আর হলদে ফুলে আমার
বারান্দাটা ছেয়ে গেল!
কোন রাতে ছেলেটি জিজ্ঞেস করে,
-ছাদে শুয়ে কোন দিন রাতের আকাশ
দেখেছেন? না দেখলে একদিন চেষ্টা
করবেন। কি রহস্য ঘিরে আছে ঐ
অন্ধকারে!
কথা হতো- প্রিয় রং, গান আর গল্পের বই
নিয়ে,
- জানেন? রবীন্দ্রনাথের উপর আমার খুব
অভিমান!
-তাই? ছেলেটি অবাক হয়।
- কি হতো শেষমেশ লাবণ্যের সাথে
অমিতের জোড়াটা লাগিয়ে দিলে?
ছেলেটা হাসতো! মেয়েটা লজ্জা
পেত সে হাসির শব্দ শুনে! ধূর! কেন যে
কথাটা বলতে গেলাম! মেয়েটি মনে
মনে নিজেকে শাসায়!
রং নাম্বারে এসেছিল সে ফোন!
নাম্বার মিলাতে মিলাতে একদিন
ঠিক নাম্বারে কল করে ফেলে
ছেলেটি। সেই হতে মেয়েটি খুব
সযতনে খেয়াল করলো, আর কোন ফোন
আসে না মেয়েটির ল্যান্ডফোনে!
মেয়েটি অপেক্ষায় থাকে। সেই
অপেক্ষার অবসান ঘটাতে কেউ আসে
না।
তারপর সময় যখন গড়িয়ে যাচ্ছিল
ক্যালেন্ডারের পাতা ধরে- কোন এক
সময়ের মুগ্ধতা আর ভাল লাগাটাকে
পুরোপুরি দখল করে নেয় অভিমানের
পুরুত্বটা । কোন একদিন মেয়েটা ভুলে
যায়- নিয়ম করে রোজ ল্যান্ডফোনে
আসা কলটির কথা!
শালিক পাখি দুটোর সংসারটা
আরেকটু বড় হয়েছে, রাজহাঁসটাও সঙ্গী
জুটিয়ে ফেলেছে ততদিনে।
মেয়েটির তাতে নিসঙ্গতা বেড়েছে
বৈকি!
অনেকগুলো দিন পেরিয়ে তারপর
আরেক শেষ বিকেলে গোধুলীর আলো
যখন একরাশ মন খারাপের শূণ্যতা সৃষ্টি
করছিল তখন আবার বেজে উঠল
মেয়েটির ল্যান্ডফোনটি।
-হ্যালো? এটা কি সুদীপার নাম্বার?
- সুদীপা বলে এখান কেউ থাকে না।
ঠোঁট কামড়ে ধরে উত্তর দেয় মেয়েটি।
ফোনের অপর প্রান্তে খানিকক্ষন চুপ
করে থাকে ছেলেটি।
- আমি জানি, এটা সুদীপার নাম্বার
না।
- জানেনই যখন তখন ফোন করার কি
দরকার ছিল?অনেকদিনের জমানো
অভিমান রাগ হয়ে ঝরে পরল মেয়েটির
কন্ঠে!
- কিছু কথা বলার ছিল। অনুমতি দিলে
বলতে পারি।
মেয়েটির মৌনতাকে নিরব সম্মতি
ভেবে কথা বলতে শুরু করে ছেলেটি।
- সুদীপা আমার মায়ের বান্ধুবীর
মেয়ে। ছেলের বউ হিসেবে
সুদীপাকে মায়ের পছন্দ। যদিও মায়ের
চেয়ে মায়ের বান্ধুবির আগ্রহটাই
বেশি। পড়াশুনা শেষ হয় নি আমার।
তাতে চেনাজানায় ক্ষতি কি?
ল্যান্ডফোনের নাম্বারটি মার ই
দেওয়া। কিন্তু কে জানতো? সাত
ডিজিটের কোন সংখ্যাটি ভুল হয়ে
যাবে টুকে নিতে?
দম বন্ধ করে ছেলেটির কথা শুনে
মেয়েটি,
- আমি আপনাকে সুদীপাই
ভেবেছিলাম। পরিচয় অস্বীকার করতে
ধরে নিয়েছিলাম হয়তো বাজিয়ে
দেখছেন অচেনা আগুন্তুকটিকে!
ছেলেটি দম নিতে থামে। আবার বলে
উঠে,
- তারপর, মার সাথে একদিন সুদীপাদের
বাড়ি গেলাম। সুদীপার সাথে কথা হল
সেদিন। মোবাইল নাম্বারটিও নিয়ে
নিলাম। কথা এর পর হতে মোবাইলে হত,
ল্যান্ডফোনের কথাটি সুদীপাকে আর
খুলে বলতে পারি নি, ভয় ছিল- সুদীপা
যদি জানে ফোন কলটি আমিই
করেছিলাম হয়তো রাগ করে কথা বলাই
বন্ধ করে দিবে।
- জানেন? মোবাইলের সুদীপার মাঝে
আমি ল্যান্ডফোনের সুদীপাকে
খুজতাম। খুঁজতে যেয়ে মিল না পেয়ে
অবাক হয়েছি বারংবার!
- তারপর?
- অবাক আর হতাশাটায় যেদিন সুদীপার
বাসায় ছুটে গিয়েছি তখনও উত্তর পাই
নি কোন! বের হয়ে হতাশ চোখে
তাকালাম পাশের কৃষ্ঞচূড়া গাছটার
দিকে। হুট করে মনে পড়ল, আরেহ বাড়ির
পাশে তো সোনালী সোনালু আর
জারুল গাছ থাকার কথা!!
দম বন্ধ করে রিসিভারে কান পেতে
থাকে মেয়েটি।
- সুদীপার কাছে আবার যাই। সবটা
খুলে বলি। ও জানায় ল্যান্ডফোনে
কারো সাথে ওর এভাবে কথা হয় নি।
একটা কথা জিজ্ঞেস করি? সেদিন
কেন বললেন না? আপনি সুদীপা নন?
- আপনাকে বুঝানোর কি কম চেষ্টা
করেছি?রং নাম্বারে ল্যান্ডফোনে
কম কল আসে নি। সবারই তো একটু কথা
বলার ছুতো। আমি তো ভেবেছি
সুদীপা নামটি আপনার বাহানা মাত্র!!
- জানেন? ল্যান্ডফোনের নাম্বারটা
তেমন গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করি নি আর
ততদিনে আপনার নাম্বারটাও ভুলে
গিয়েছি প্রায়। যতটুকু মনে পড়ল কল
দিয়ে দেখলাম রং নাম্বার।
- তারপর? খুঁজে পেলেন তো শেষ পর্যন্ত!
- না হলে কথা বলছি কিভাবে আপনার
সাথে? তবে জানেন কি? কম কাঠখড়
পুড়াতে হয় নি আমার!
- ঠিক কিরকম?
-বুঝতে পারছিলাম না কোন
ডিজিটটায় তালগোল পাকিয়ে
ফেলিছি! শেষে গনহারে সংখ্যা
পরিবর্তন করে কল দিতে লাগলাম!
- সে কি!! এতোটা বেপরোয়া না
হলেই কি হত না? সুদীপাকে তো
পেয়েই গেলেন।
- একটা কথা কি জানেন? একজনের
মাঝে আরেকজনকে খুঁজতে থাকা যে
কি ভয়ংকর ব্যাপার সেদিন বুঝেছি!
সুদীপাকে পেয়ে কি লাভ হলো?
খুঁজছিলাম তো আপনাকে!
- তাহলে অনেক মানুষের অলস সময়ে
বিরক্ত করেছে আপনার ল্যান্ডফোন?
- মোটেও না। বলেছিলাম না? আমার
রং নাম্বারে ফোন খুব কম যায়? তাই ১৩
তম বারের চেষ্টায় আবার আপনাকে
পেলাম! এবার বলুন তো? আপনার
নামটা?
একটু সময় নিয়ে উত্তর দেয় মেয়েটি।
-মূর্ছনা।
ছেলেটিকে চুপ করে থাকতে দেখে
মেয়েটি বলে উঠে,
-নাম শুনে এমন চুপ হয়ে গেলেন যে?
নামটা কি সুদীপার চেয়ে খারাপ
শুনতে?
- কানের মাঝে সারাক্ষণ বেজে
থাকার মত শব্দ- মূর্ছনা।
হালকা হাসল মূর্ছনা।
- এবার ঠিকানাটা বলুনতো। আমার
মুখস্ত বিদ্যাটা বরাবরই খারাপ। পরের
বার যদি কোন দিন ভুলে যাই তবে
সোজা বাসায় চলে আসব!!
-ঢং। নাক সিটকে উত্তর দেয় মূর্ছনা।
- দিবেন না তাহলে? ঠিক আছে।
তারপর বাসা খুঁজতে খুঁজতে যদি আবার
ভুল ঠিকানায় চলে যাই তবে কিন্তু
সারা জীবন আফসোস করবেন।
মুর্ছনা চুপ করে যেন আফসোসের
পরিমাণটা ভাবতে থাকল। তারপর বলল,
- শহরের উত্তরের শেষ প্রান্তের গলির
মোড়ে তাকিয়ে দেখবেন চার পাচঁটা
দোতলা তেতলা বাসা।
নেমপ্লেটগুলো উঠে গিয়েছে অনেক
আগেই। যে বিল্ডিংটার বারান্দা
ছোঁয়া সোনালী সোনালু আর জারুল
ফুল গাছ . . . . . . .

.

-Fahima Surovi

No comments:

Post a Comment