Sunday, July 30, 2017

গল্প: তুই আমার কে?

গল্প: তুই আমার কে?

|| এক ||

"আচ্ছা আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে পারিস না তুই?"

"তোকে নিয়ে কি কবিতা লিখবো। আজাইরা।"

"দ্যাখ, আজাইরা বলবিনা। ক্যান আমাকে নিয়ে লিখলে কি হয়?"

"তুই কি আমার গার্লফ্রেন্ড?"

"এহ নীরা, অদিতি, বিনোদিনী এব্রাকাজেব্রাকা এইডি কি তোর গার্লফ্রেন্ড লাগে?"

"হ লাগে তো।"

"প্লিজ আমার জন্য একটা কবিতা লিখ না।"

"আচ্ছা লিখবো যা। যদি বিড়ি খাওয়াস।"

"তুই কি মানুষ হবি না।"

"খাওয়াবি কিনা বল। নো সিগারেট নো কবিতা।"

"ওকে যাহ! একটা খাওয়াবো। এবার লিখে দে প্লিজ।"

"তাইলে চল দুই তিন কেজি প্রেম করি। প্রেম ছাড়া কি কবিতা আসে রে।"

"কুত্তে কামিনী তোর সাথে প্রেম করবো আমি। ইয়াক!"

"যাহ ফোট। তোর জন্য কোন কবিতা লিখুম না। তোর ভাতাররে লিখতে কইস।"

"ছিঃ কি বিচ্ছিরী তোর ভাষা। প্লিজ লিখে দে না।"

জাহিদ যেই ব্যাপারে না বলে সেই ব্যাপারে নাজনীন আরো উঠেপড়ে লাগে। জাহিদকে না জ্বালালে ওর ভাল লাগে না। কিন্তু কবিতার জন্য জোড় করতে করতে ওর নিজেরও খুব ইচ্ছে করছে জাহিদের কাছ থেকে কবিতা পেতে। জাহিদের সব কবিতাই নাজনীন মুগ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু বুঝতে দেয় না ওর যে ভাল লাগে। বরং প্রায় সময় বলে কি সব ছাইপাঁশ লিখে।

এভাবে কিছুক্ষণ খুনসুটি করতে করতে জাহিদ আর নাজনীন ক্যান্টিনের দিকে চলে যায়।

|| দুই ||

ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই ওরা দু'জন বেশ দারুণ বন্ধু। জাহিদের সাথে পরিচয়টা হয় অদ্ভুত ভাবে। জাহিদ ফোনে কথা বলতে বলতে আসছিলো। নাজনীনও সেদিকেই যাচ্ছিলো। জাহিদ হাতের ঈশারায় নাজনীনকে থামিয়ে বলে, "ফোনে একটা নাম্বার নোট করো।" নাজনীন  ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হুট করে চিনে না জানে না একটা ছেলে ওর সাথে এভাবে কথা বলায় নার্ভাস হয়ে যায়। আজই ওর ভার্সিটির প্রথম দিন। জাহিদ ফোনে কথা বলে নাম্বার নিচ্ছে আর নাজনীন সেটা মোবাইলে তুলে নিচ্ছে।

জাহিদ ফোন রেখে বলে, "দেখি নাম্বারটা দাও।" নাজনীন এবার যথেষ্ট বিরক্ত হয়। ছেলেটা ওকে তুমি তুমি করে বলছে কেন! ও ফোনটা এগিয়ে দেয়। জাহিদ নাম্বারটা ওর ফোনে টুকে নিয়ে কল করতে গিয়ে দেখে কল যায় না। নাম্বার চেক করে দেখে ১০ টা ডিজিট।

জাহিদ নাজনীনের দিকে তাকিয়ে একটা ঝারি দিয়ে বলল, "এই সামান্য কাজটাও করতে পারো না। নাম্বার ভুল তুলো কেন। সামান্য এই কাজটাও করতে না পারলে পারবাটা কি।"

নাজনীন তো এবার পুরাই তাজ্জব। কি আশ্চর্য! ছেলেটা এভাবে বকছে কেন ওকে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। রাগে শরীর গুলাচ্ছে। রেগে গেলে ওর গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। গট গট করে হেঁটে চলে গেল। জাহিদ ফিরেও তাকালো না ওর দিকে। সে ফোন করে আবার নাম্বার নিচ্ছে।

|| তিন ||

নাজনীন প্যাসেজের শেষদিকে মুখে বৈশাখীর কালো মেঘ জমিয়ে বসে আছে। চোখ ছলছল করছে। কারো সাথে তেমন একটা বন্ধুত্ব ওর হয়নি। দুই একজনের সাথে টুকটাক হাই হ্যালো হয়েছে। ছেলেটা ওর সাথে এমন আচরণ করলো কেন কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। খুব কান্না পাচ্ছে ওর। নাজনীন অনেক চঞ্চল একটা মেয়ে। এখনো বাচ্চা মেয়েই বলা যায়। খুবই ইমোশনাল। ওর সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করলে বিশেষ করে বকা দিলে ওর সহ্য হয় না।

"নাও ধরো।"

আচমকা কথাটা শুনে হটচকিয়ে যায় নাজনীন। পাশে ফিরে দেখে সেই ছেলেটি। একটা আইসক্রিম ওর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। মেজাজটা এবার সপ্তমে চড়ে গেল। ছেলেটার সমস্যাটা কি। কেন ওকে জ্বালাচ্ছে। খুব কড়া কিছু বলার জন্য মনে মনে কথা গুছিয়ে নিল। সহ্যের তো একটা সীমা থাকে।

"আমি ভ্যানিলা খাই না। চকলেট খাই।"

নিজের কথা শুনে নিজেই হতবাক হয়ে যায় নাজনীন। কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলল। নিজের উপরে রাগ হচ্ছে এবার।

ছেলেটা ওর নিজের আইস্ক্রিমটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, "আমি তো শুনেছি মেয়েরা ভ্যানিলা পছন্দ করে। আর যেই মেয়েরা চকলেট পছন্দ করে সে মেয়েরা ব্যাটা ব্যাটা টাইপের হয়।"

ছেলেটার কথা শুনে নাজনীন ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো হতে গিয়ে ফিচ করে হেসে দিলো। ও বুঝতে পারছে ছেলেটা এখন স্রেফ রাগানোর জন্য এই কথা গুলো বলছে। ছেলেটার কথায় আর নাচা যাবেনা। এরমধ্যে অনেক নাচা হয়ে গেছে।

বেশ স্বাভাবিক ভাবেই নাজনীন আইস্ক্রিম হাত বাড়িয়ে নিলো। কিন্তু আইস্ক্রিম হাতে নিয়ে বসেই আছে। আইস্ক্রিম খাবে কি খাবে না বুঝতে পারছেনা।  ছেলেটা ওর পাশে এসে বসলো। আইস্ক্রিমে হালকা কামড় দিয়ে বলল, "খাচ্ছো না কেন!"

"এইতো খাব একটু পরে।"

বলে আইস্ক্রিম হাতে মাথাটা নিচু করে বসে রইলো নাজনীন।  হঠাৎ ছেলেটা ওর হাত থেকে আইস্ক্রিমটা নিয়ে দাঁত দিয়ে প্যাকেটটা একপাশ থেকে ছিঁড়ে নাজনীনের দিকে এগিয়ে দেয়। নাজনীনের কেন জানি ব্যাপারটা খুব ভাল লাগলো।

এবার ওরা দু'জন প্যাসেজে বসে আইস্ক্রিম খাক। আমরা বরং ক্যান্টিনে গিয়ে দেখে আসি ওরা কি করছে।

|| চার ||

"নে ধর।"

"ধরা লাগবে কেন টেবিলে রাখ।"

"নারে নীলা তুই পিরিত বুঝলি না।"

"থাক আর বুঝে কাজ নাই। আগে পেট পূজো। সসটা দেতো।"

"নিজে নিতে পারিস না।"

"আইলস্যা পোলা কোথাকার।"

নাজনীনের কথা শুনে জাহিদ হাসতে হাসতে সিংগারায় কামড় বসায়। ওরা ক্যান্টিনে খাওয়ার সময়ই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। জাহিদ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। ওর চোখ জানালার কাঁচ ভেদ করে ৩ বছর আগের কোন এক বরষার দিনে ফিরে গেছে।

কত কি যে মনে পড়ে যাচ্ছে। আহা তিন বছর। কি করে চোখের পলকে কেটে গেল। নাজনীনের সাথে প্রথম যেদিন পরিচয় হয় সেদিনইও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিলো।

সেদিন আইস্ক্রিম খেয়ে নাজনীন লাইব্রেরীতে চলে যায়। আর জাহিদ ওর এক বন্ধুর সাথে ওদের ডিপার্টমেন্টের স্যারের সাথে দেখা করতে যায়। স্যারের রুম থেকে বেড়িয়েই দেখে ঝুম বৃষ্টি। ভার্সিটির গেইটের কাছে এসে দাঁড়ায় জাহিদ। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আকাশের বুকে কোন অংশ খালি নাই। পুরো আকাশ ছিদ্র হয়ে বৃষ্টি ঝড়ছে। এই বৃষ্টি আর এই জনমে থামবে না।

একটু পরে দেখতে পেলো নাজনীন ওর পাশ দিয়ে গটগট করে ছাতা খুলতে খুলতে গেইটের বাইরে চলে যাচ্ছে। জাহিদ অবাক হয়ে দেখছে। মেয়েটা এখনো ছাতা খুলতে পারেনি অথচ বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় নেমে পরেছে। সামান্য ভেজার পরে নাজনীন ছাতা খুলতে পেরেছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বোধহয় রিক্সা খুঁজছে।

জাহিদের হঠাৎ মনে হলো আজ বৃষ্টিতে ভিজলে মন্দ হয় না। সেলফোন মানিব্যাগ সিগারেটের প্যাকেট লাইটার সব কাঁধের ব্যাগে ঢুকালো। এই ব্যাগের ভিতরে পানি ঢুকবে না বলেই রক্ষা। না হলে বৃষ্টিতে ভিজার ইচ্ছাটা মাঠেই মারা যেত।

ঝুম বৃষ্টির নিচে জাহিদ পিচঢালা পথে নেমে পরলো। জুতোর ভিতরেও পানি ঢুকছে। হাঁটতে বেশ মজাই লাগছে। কিছু মানুষ একটু অবাক হয়ে দেখছে জাহিদকে। এমন সময় একটা রিক্সা প্রায় পাশে এসে দাঁড়ালো। রিক্সার ভিতর থেকে মুখটা একটু বের করে নাজনীন জাহিদকে হাত নেড়ে ডাকলো।

"এই যে, এই। আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন উঠে আসুন। কোথায় যাবেন আপনি। ছাতা নিয়ে বের হতে পারেন না জানেন না এখন বৃষ্টির দিন।"

জাহিদ বুঝতে পারছিলোনা মেয়েটার কোন প্রশ্নের জবাব দিবে। মেয়েটার নাম কি যেন বলেছিল হঠাৎ করে গুলিয়ে ফেলেছে ও। কি যেন নাম? নীলা না! হ্যাঁ নীলাই তো।

"নীলা তুমি যাও আমি ভিজবো।"

"আমার নাম নীলা না নাজনীন।"

"ঐ হলো একটা। নীলাই ভাল।"

সেদিন থেকেই নাজনীনকে নীলা বলেই ডাকে জাহিদ। নাজনীন অবশ্য এই নিয়ে বেশ কয়েকবার গাইগুই করেও লাভ হয়নি দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছিলো।

"ভাল খারাপ পরে হবে এখন রিক্সায় উঠুন।"

নাজনীনের হঠাৎ মনে হল আজই মাত্র ছেলেটার সাথে পরিচয়। এতো কেয়ার করার কি আছে ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজলো কি ভিজলো না। সংকোচ হচ্ছিলো মনে মনে ছেলেটাকে রিক্সায় উঠতে বলায়।

"না আমি বৃষ্টিতে আরো কিছুক্ষণ ভিজবো। চাইলে তুমিও চলে আসো।"

"বৃষ্টিতে ভিজলে আমার সর্দি হয়।"

"আরে কি বল। বৃষ্টিতে ভিজা তো অনেক রোমান্টিক একটা ব্যাপার।"

"আমার এতো রোমান্স লাগবেনা। প্লিজ আপনি আর ভিজবেন না। উঠে আসুন।"

"কাল দেখা হবে নীলা। তুমি যাও কেমন।"

বলেই হাঁটতে শুরু করলো জাহিদ। নাজনীনের মেজাজ বিগড়ে গেল। রাগে ফুঁসছে সাপের মতোন। এতোবার অনুরোধ করলো অথচ ছেলেটা কথা গুলো গা ও করলো না। ব্যাগ খুলে রিকশা ভাড়া দিয়ে নাজনীনও রাস্তায় নেমে পরলো ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে।

জাহিদের পাশ দিয়ে টুংটাং করতে করতে রিক্সাটা যাচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে রিক্সায় কেউ নাই। পিছন ফিরে দেখে নাজনীন পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে ভাঁজ করা ছাতা। জাহিদ এগিয়ে যাচ্ছে নাজনীনের দিকে।

"এই গাধা কি হলো খাচ্ছিস না কেন?"

নাজনীনের কথায় আবার বাস্তবে ফিরে এলো জাহিদ। সিংগারায় আরেকটু সস মাখিয়ে পুরোটা মুখে পুরে দিলো। জানালার কাঁচে চুইয়ে চুইয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে। বৃষ্টিতে সব মানুষের মনই অতীতে চলে যায়। কেউ ক্ষত গুলো মনে করে মনটাকে বিষাদে ভরায়। কেউ সুখে হারিয়ে যাওয়া সময় গুলো মনে করে নস্টালজিক হয়।

"আচ্ছা নীলা তোর কি মনে আছে তোর আমার প্রথম পরিচয়ের দিনটার কথা। সেই বৃষ্টিতে ভিজার কথা।"

"উফফফ! জঘন্য! আমি সেই দিনের কথা মনেও করতে চাই না।"

"হাহাহা! আমার কিন্তু বেশ লাগে মনে করতে। কি পাগলীটাই না ছিলি।"

"প্লিজ থামবি তুই। সেই টং দোকানের লোক গুলো। এতো নোংরা ছিল ওদের চাহনি।"

"ওদের কি দোষ বল। আমি নিজেও তো..."

"দেখ বাজে বকবি না। একদম বাজে বকবি না। মেয়েদের তৃতীয় একটা চোখ থাকে। সেই চোখ দিয়ে বুঝে কে তার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে। তুই মোটেই নোংরা ভাবে তাকাসনি।"

বলেই নাজনীনের মুখটা লজ্জায় আভা ছড়ালো। সেই দিনটা যে নাজনীনের জীবনের সেরা একটা দিন সেটা কোনদিন ও জাহিদকে জানতে দিবে না। যতবার সেইদিনের কথা ওর মনে পরে ততবার ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠে। কেন্টিন থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেল নাজনীন। জাহিদকে বলল, "বিল দিয়ে দিস। আমি আসছি একটু পরে।"

"কই যাস তুই। এই..."

নাজনীন আর কোন কথা না বলে পালালো। ওর এই চেহারা ও জাহিদকে দেখাতে চায় না।

|| পাঁচ ||

নাজনীন সেই প্যাসেজে গিয়ে দাঁড়ালো যেখানে জাহিদ ওকে প্রথম আইসক্রিম খাইয়েছিলো। বৃষ্টিতে ভিজে আছে নইলে একটু বসা যেতো এখানে।

সেই প্রথম দিন জাহিদ রিক্সায় না উঠে গটগট করে চলে যাওয়ায় নাজনীনের ভিতরটা কেমন যেন উলোটপালোট হয়ে গিয়েছিলো। রাগে নেমে গেলো রিক্সা থেকে। কি করবে বুঝতে পারছিলো না। জাহিদ একমনে হেঁটেই যাচ্ছিলো। একবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছেও না। একটা মেয়ে এভাবে একা দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে আর কেয়ারলেসটা হেঁটেই যাচ্ছে। ভীষণ রাগ হচ্ছিলো জাহিদের উপরে।

কিন্তু জাহিদ কে? কেউ না। আজই প্রথম পরিচয়। তেমন কোন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও তৈরি হয়নি। তবুও কেন ছেলেটার অবহেলা ওর সহ্য হচ্ছে না। এসব পাত্তা না দিলেই তো হয়। রিক্সা জাহিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জাহিদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। নাজনীনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর দিকে আসতে লাগলো।

নাজনীন জাহিদকে আসতে দেখে ওর দম আটকে গেল। হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরলো। কেন ওর এমন লাগছে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টির সাথে বাতাসের বেগও বাড়ছে। পাশ দিয়ে রিক্সা যাওয়ার সময় রিক্সাওয়ালা আর যাত্রিরা ঘাড় ঘুরিয়ে নাজনীনকে দেখছে।

বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা কাঁপিয়ে দিচ্ছে নাজনীনকে। জাহিদ যতো কাছে আসছে নাজনীনের ভিতরটা ততো কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখ সরাতে চাইছে জাহিদের দিক থেকে কিন্তু পারছে না।

"কি হলো রিক্সা ছেড়ে দিলে কেন?"

"আ... আমি চা খাবো। খুব ঠাণ্ডা লাগছে।"

জাহিদ আর কথা বাড়ালো না। সামান্য দূরেই একটা টং দোকান দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই পা বাড়ালো ওরা। নাজনীন আড় চোখে বারবার দেখছে জাহিদকে। জাহিদ ওর দিকে তাকালেই আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। নাজনীন বুঝতে পারছে না ওর কি হচ্ছে আজ। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর। এমনটা আগে কখনোই হয়নি। কেমন ঘোর লাগা একটা অনুভূতি। বুকটা কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগছে শুধু।

দু'জনে নিশ্চুপ হেঁটে দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। মোটামুটি ভির আছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে দুই কাপ চায়ের অর্ডার করলো জাহিদ। আশেপাশের অনেকে হা করে গিলছিলো নাজনীনকে। বৃষ্টিতে ভিজে সারা শরীরের কাপড় লেপ্টে আছে। জাহিদ কেমন যেন মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো নাজনীনকে।

নাজনীন জাহিদের চাহনি বুঝতে পেরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। ওর সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। চায়ের কাপে ঠিক মতো চুমুক দিতে পারছিলো না। হঠাৎ নাজনীনের আশেপাশের মানুষ গুলোর দিকে খেয়াল হলো। মানুষ গুলোর চাহনি দেখে গা গুলিয়ে উঠলো। চা খেতেও বমি বমি লাগছে।

ঠিক তখনই হুট করেই জাহিদ ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে ব্যাগ থেকে মানিব্যাগ বের করে চায়ের বিল দিলো। নাজনীন কিছু বুঝে উঠার আগেই জাহিদ ওর হাত ধরে টং দোকান থেকে বের হয়ে গেল। নাজনীন তখনো হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জাহিদের দিকে। একটা খালি রিক্সা দেখে জাহিদ ডাক দিলো।

"এই মামা যাবেন।"

"আমার রিক্সায় পর্দা নাই মামা।"

"সমস্যা নাই। বেপর্দা রিক্সাতেই যামু।"

জাহিদের কথা শুনে রিক্সাওয়ালা আর নাজনীন হেসে দেয়। ওরা রিক্সা বসতেই জাহিদ রিক্সাওয়ালাকে হুড ফেলে দিতে বলে। নাজনীনের খুব ভাল লাগলো এভাবে রিক্সায় বসে বৃষ্টিতে ভিজতে। জীবনে এই প্রথমবার ও বৃষ্টিকে এতোটা অনুভব করতে পারছে।

"টং দোকান থেকে এভাবে আমায় নিয়ে এলেন কেন?"

"কেন খেয়াল করোনি টং দোকানের লোক গুলো হা করে কিভাবে তোমায় গিলছিলো। আমার ভাল লাগছিলো না ব্যাপারটা।"

নাজনীনের ইচ্ছে করছিলো জাহিদের হাতটা ধরতে। কিন্তু সংকোচে হাত মুঠো পাকিয়ে রাখলো। রিক্সায় ভিজতে ভিজতেই মনে হলো ওর, এই একটা মানুষই ওকে সারাজীবন আগলে রাখতে পারবে। কে বলবে আজই জাহিদের সাথে ওর প্রথম পরিচয়। মনে হচ্ছে কত যুগের চেনাজানা পরিচিত ওরা। অনেকদিন পরে যেন আজ হুট করে দেখা হয়ে গেল।

|| ছয় ||

"কিরে নীলা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?"

"না এমনি। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয় না। আজ আর ক্লাস করবো না।"

"তোর শরীর খারাপ করেনি তো।"

"নারে এমনি। ইচ্ছে করছে না ক্লাস করতে।"

"চল তাইলে।"

বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু মেঘ কাটেনি। যেকোনো সময় আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। দু'জনে রিক্সায় চাপলো। নাজনীনের ভিতরে এখনো সেই প্রথম দেখা হওয়া দিনের কথা মনে পড়ছে। সেদিন বাসায় গিয়ে প্রচণ্ড জ্বর এসেছিলো ওর। পাঁচদিন ভার্সিটি আসতে পারে নাই। কেউ কারো ফোন নাম্বারও রাখেনি। দু'জনেই অস্থির হয়েছিল দু'জনকে দেখার জন্য। কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে দেয়নি।

রিক্সা করে নাজনীনকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে একটা গিফটশপে ঢুকলো জাহিদ। আগামীকাল নাজনীনের জন্মদিন। কি গিফট দেওয়া যায় ভাবছে। গতবার একটা টেডিবিয়ার দিয়েছিলো। এর জন্য অবশ্য কম খামচি খেতে হয়নি। এবার কোন খামচি খাওয়ার স্বাদ নেই। বের হয়ে এলো শপ থেকে। হঠাৎ চোখ গেলো সামনের কসমেটিকসের দোকানে। মাল্টিকালারের এক সেট চুড়ির দিকে নজর আটকে গেলো।

বাসায় এসে ভিতরে ভিতরে খুব অস্থির হয়ে গেল জাহিদ। কেন যেন মনে হচ্ছে নাজনীনকে কিছু একটা দেওয়া উচিৎ। কিন্তু সেটা কি তা বুঝতে পারছে না। ওরা খুব ভাল বন্ধু। তবুও মন কেন যেন শুধু বন্ধু ভাবতে চাইছে না আর। সেই প্রথম দিন জাহিদ টং দোকানে নাজনীনকে ভেজা শরীরে দেখে ওর মনে একটা গভীর আলোড়ন হয়েছিলো। কি যে অপরূপা লাগছিলো নাজনীনকে। ওর চুল বেয়ে বৃষ্টির জল গড়াচ্ছিলো। গাল থেকে জল চুইয়ে চুইয়ে চিবুক দিয়ে ঝরছিলো। জাহিদের খুব ইচ্ছে করছিলো হাত দিতে চিবুকের জল ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু নাজনীন কি না কি ভাবে তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। আর তাছাড়া কেউ কাউকে তখনো ভাল করে চিনে না।

কোথায় যেন জাহিদ পড়েছিলো, মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দরী লাগে গোসলের পরে আর শেষ বিকেলের লালচে আলোয়। কিন্তু বৃষ্টিভেজা নাজনীনকে দেখে মনে হলো এভাবেই মেয়েদের সবচেয়ে বেশি অপরূপা লাগে। হঠাৎ যখন দেখলো আশেপাশের মানুষ গুলো খুব নোংরা ভাবে নাজনীনকে দেখছে ওর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ও ছাড়া কেউ নাজনীনকে এভাবে বৃষ্টিভেজা শরীরে দেখবে-তা কি করে হয়। সাথে সাথে ওর হাত ধরে টং দোকান থেকে বের হয়ে এলো।

নাজনীনকে ও শুধু বন্ধু না তারচেয়েও আরো বেশিকিছু ভাবে। কিন্তু ও চায় না ওদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যাক। তাই নিজের অনুভূতি গুলো বুকে চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু আজ বারবার মনে হচ্ছে নাজনীনকে কিছু জানানো দরকার। যা হয় হোক। ও শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই।

|| সাত ||

"হ্যাপি বার্থডে নীলা।"

"বাব্বাহ! আজ এতো পাংচুয়াল হয়ে গেলি কেন। প্রত্যেক বছর তো রাত দুপুরে ফোন দিয়ে ঘুম ভাংগাতি। আজ একেবারে ১২ টা বাজতেই কল।"

"গাধী আগে থ্যাংকইউ বল। কেউ উইস করলে ধন্যবাদ জানাতে হয় এই ভদ্রতাটুকুও কি জানিস না।"

"হইছে থাক। আর লেকচার ঝাড়িস না। আগে যাও একটু আধটু ভদ্র ছিলাম। তোর সাথে থেকে তো তাও গেছে।"

"বাজে বকিস না নীলা। আজ অন্তত ঝগড়া করিস না।"

"জাহিদ!"

"হ্যাঁ! বল।"

"কিছু না।"

নাজনীন টেবিলল্যাম্প জ্বেলে বসে আছে। এক হাতে ফোন। আর অন্য হাতে কলম দিয়ে পুরো কাগজে জাহিদের নাম লিখে ভরিয়ে ফেলেছে। ও জাহিদের নাম লিখতে লিখতেই জাহিদ কল দিয়েছে।

"বল না কি বলবি।"

"কিছু না রে। আমি ফোন রাখছি কাল দেখা হবে।"

"আচ্ছা।"

বলতে বলতেই নাজনীন লাইন কেটে দেয়। জাহিদ বুঝতে পারছে না কি করবে। নাজনীন ফোন রেখে দেওয়াতে ভালোই হয়েছে। নইলে ঠিক ঠিক আজ কিছু একটা বলে দিতো। ডায়েরি আর কলম নিয়ে বসলো জাহিদ।

নাজনীন কল কেটে নিচের ঠোঁট কামড়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মন বলছে জাহিদ কল দিবে। কিন্তু জাহিদের আর কল আসে না। নিজে থেকে কল দিতেও সংকোচ হচ্ছিলো। নাজনীন মনে মনে ভাবছে, স্টুপিডটা কি কিছুই বুঝে না। ও শুয়ে পড়লো। শুয়ে শুয়ে স্ক্রিনের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়েই আছে।

ঠিক ১:২৫ মিনিটে জাহিদ কল দিলো। একটা রিং পড়তেই কল রিসিভ করে ফোন কানে নিতে নিতে উঠে বসলো নাজনীন।

"হ্যালো!"

"নীলা ঘুমাও নাও। মানে ঘুমাস নাই।"

নাজনীনের বুকের ভিতরে একটা শিহরন বয়ে গেল। ওদের বন্ধুত্ব হওয়ার পরে দু'জন দু'জনকে তুই করে ডাকে। ইদানীং নাজনীনের খুব ইচ্ছে করে জাহিদের মুখ থেকে "তুমি" শুনতে। কিন্তু গাধাটা তো ভুলেও ভুল করে ডাকে না। আজ হঠাৎ শুনতে পেয়ে সারা শরীর কেঁপে উঠলো ওর।

"না ঘুমাইনি। তুই ঘুমাস নাই কেন?"

"এমনি। আচ্ছা ঘুমানোর ট্রাই কর। রাখছি।"

"কল দিয়েছিস কেন?"

"তোর ভয়েসটা শুনতে ইচ্ছে করছিলো তাই।"

মুখ ফসকে মনের কথাটা বের হয়ে যাওয়াতে অপ্রস্তুত হয়ে গেল জাহিদ।

"কি বললি। আবার বল।"

"আরে ধুর আজাইরা। এমনিই কল দিছি। রাখি রে কাল দেখা হবে।"

"না! প্লিজ না! তুই রাখবি না গাধা..."

নাজনীনের কথা গুলো আর শোনা হলো না জাহিদের। তার আগেই কল কেটে দিয়েছে। নাজনীনের বুকটা ভরে গেছে জাহিদের কথাটা শুনে। ওর ইচ্ছে করছে কল দিতে। কিন্তু ও কল দিবে না। জাহিদের কথাটা ওর বুকে আরো কিছুক্ষণ বাজুক। সারাজীবন বাজতে থাকুক।

|| আট ||

নাজনীন বরাবরের মতোন আগে এসে প্যাসেজে বসে আছে। জাহিদের এখনো পর্যন্ত কোন খবর নাই। ও ঠিক করেছে আজ দেড়ি করে আসা নিয়ে কোন ঝগড়া করবে না। কাল রাতের মুগ্ধতা এখনো কাটেনি নাজনীনের।

"নে ধর বার্থডে গার্ল।"

"কি দরকার ছিল আসার। না এলেই পারতি।"

"আরে এখানে দেখি ব্যাটাদের আইসক্রিম শেষ তাই আবার মেইনরোড থেকে আনতে হলো।"

"স্টুপিড ব্যাটা ব্যাটা আইসক্রিম বলবি না। অনেক মেয়েই চকলেট ফ্লেভার পছন্দ করে।"

"তুই আলাদা। তোর তো সবকিছুই ব্যাটাদের মতো। হাঁটাচলা পর্যন্ত।"

"মাইর খাইস না। আগে আমার বার্থডে গিফট দে।"

"কিসের গিফট। তুই আমার কে যে তোকে গিফট দিতে হবে। আজাইরা।"

"খবরদার আর একবার আমারে আজাইরা বলবি না।"

"আচ্ছা যা আজকের জন্য আর বলবো না।"

"উঁহু আজ না। তুই কখনোই বলতে..."

নাজনীনের কথা শেষ হওয়ার আগেই জাহিদ ওর দিকে মাল্টিকালারের চুড়ি গুলো বাড়িয়ে দিলো। নাজনীন মোটামুটি একটা ঝাঁকি খেলো। অবাক হয়ে জাহিদের হাত থেকে চুড়ি গুলো নিলো।

তেমন আহামরি চুড়ি না। কিন্তু পছন্দের মানুষ সামান্য একটা চুলের ক্লিপ দিলেও সেটার আবেদন থাকে সব থেকে বেশি। নাজনীন চুড়ি গুলো এক হাত ভর্তি করে পরে নিলো। ওর মনটা এমনিতে ভাল ছিল আরো ভাল হয়ে গেল।

সারাদিনটা খুব দারুণ কাটলো দু'জনের। একজন আরেক জনের সঙ্গটা খুব অনুভব করেছে। আজকের দিনটাই কেমন যেন। সুখের বুনোটে গাঁথা একটা দিন। সন্ধ্যার একটু আগে জাহিদ রিক্সা করে নাজনীনকে বাসায় নামিয়ে দিলো। নাজনীন বিদায় নিয়ে বাসার গেটে ঢুকতে যাবে এমন সময় জাহিদ ডাক দিলো।

"নীলা শোন!"

"বল।"

"সিগারেট খাবি!"

"মাইর চিনিস তুই। মাথায় তুলে আছাড় দিবো তোকে।"

"প্লিজ একটা খেলে কি হয়। খা না।"

নাজনীন ও বুঝতে পারছে জাহিদ ওকে ক্ষেপানোর মতলব করছে। জাহিদের কথায় নাচা যাবে না। নাজনীনও কম যায় না। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "আচ্ছা দে। তুই দোস্ত মানুষ তোর কথা ফেলি কি করে।"

জাহিদ সত্যি সত্যি ব্যাগ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। সুন্দর করে ফিতে দিয়ে বাঁধা। নাজনীন এবার বেশ অবাকই হলো।

"নে বাসায় গিয়ে চুপিচাপি খাবি। স্পেশালি তোর জন্য বানানো।"

"মানে কি জাহিদ। সত্যি সত্যি সি... সিগারেট দিচ্ছিস।"

"কি জ্বালা যন্ত্রণা! মিথ্যে মিথ্যে দিবো কেন। যাই রে। ভাল থাকিস।"

"হ্যাঁ! তুইও!"

নাজনীন তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললো কেউ দেখার আগেই। এখনো তাজ্জব হয়ে আছে ও। জাহিদ সত্যি সত্যি ওকে সিগারেট খেতে দিলো। মেজাজও বিগড়ে গেলো ওর। আজ জন্মদিনে এই কাজটা না করলেও পারতো জাহিদ।

বাসায় ঢুকতেই দেখে মোটামুটি একটা জন্মদিনের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু নাজনীনের কিছুই ভাল লাগছিলো না। সারাদিন এতো ভাল একটা সময় দিয়ে শেষে এসে জাহিদ এটা কি করলো। এতো কিছু থাকতে সিগারেট। ছিঃ এটা জাহিদ কি বুঝে করলো।

|| নয় ||

মোটামুটি মাথার যন্ত্রণা নিয়ে নাজনীন ফ্রি হলো রাত সাড়ে এগারোটায়। কাজিনদের সাথে আড্ডা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করতে করতেই রাত দশটা বেজে গিয়েছিলো। সবকিছু গুছিয়ে লম্বা একটা গোসল নিয়ে মাত্র বের হলো। গোসল দিয়েও মাথার যন্ত্রণা গেলো না। মনে হয় না আজ রাতে আর যাবে।

মাথা থেকে তোয়ালেটা খুলে চুল ভাল করে মুছে বারান্দার দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। তখনই জাহিদের দেওয়া সিগারেটের প্যাকেটের কথা মনে পরে গেলো। আবার মেজাজ ধরে গেল। মনে মনে জাহিদের চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে ফিতে খুললো।

প্যাকেট খুলতেই দেখে সেখানে কোন সিগারেট নেই। অনেক গুলো কাগজ সিগারেটের মতো গোল করে রাখা। একটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো কবিতা লিখা। সাথে সাথে ওর সারা শরীরের লোমকূপ জেগে উঠলো।

"একদিন পৃথিবীর সব কোলাহল থেমে যাবে
কোথাও কোন প্রাণের স্পন্দন থাকবে না
ঈশ্বর মুছে দিবে সব প্রেম
ধূলোবালির পৃথিবীতে কোথাও থাকবে না ভালবাসা
কোথাও থাকবে না মায়া
যা কিনা একটু আদর পেলে চুম্বন হতে পারে
হারিয়ে যাবে চোখের নোনা জল
যা কারো জন্য ঝরবার কথা ছিলো
কিন্তু...
কিন্তু ঈশ্বর যদি আমার বুকে কান পাতেন
তিনি শুনতে পাবেন আমার হৃৎপিণ্ডে
একটা নামই স্পন্দিত হচ্ছে- নীলা"

নাজনীনের হাত কাঁপছে। খুব সাধারণ এই কবিতাটুকুও নাজনীনের একেবারে ভিতরটা ছুঁয়ে গেল। সারাদিনের ভাল লাগাটুকু আরো কয়েকগুণ হয়ে ফিরে এলো। মাথার যন্ত্রণা এক নিমিষে চলে গেলো।

আরেকটা কাগজ তুলে নিলো। গোল করে পেচানো কাগজটা খুব আস্তে আস্তে খুলছে।

"একদিন খুব বৃষ্টি হবে
তুমুল বরষায় তোকে নিয়ে ভিজবো
সেদিন তোকে ভালবাসবো
সেদিন তোকে বউ বলে ডাকবো
যদি ফিরিয়ে দিস
মাথার কসম
তোকে খুন করে ফাঁসির দড়ি গলায় পরবো
কিন্তু তোকে আদায় করার দাবী ছাড়বো না নীলা
মৃত্যুর ওপাড়েও আমি তোকে চাইবো
যদি আমায় ফিরিয়ে না দিস
আমার ঘরে বউ হয়ে আসিস
মাথার কসম
আদরে আদরে তোকে বুকে পিশে
হাজার রাত্রি খুন করবো গভীর শ্বাসে"

নাজনীনের চোখ ভিজে গেছে। স্টুপিডটা তাহলে ওকে ভালবাসে। কিন্তু গাধাটা সরাসরি কেন বললো না একবারও। বললে তো ও ফিরিয়ে দিতো না। আসলেই একটা গাধা। আরেকটা কাগজ হাতে নিলো।

"তোকে আমার ভাল লাগে না জানিস
তুই দেখতে ব্যাটা ব্যাটা
আইসক্রিম খাসও ব্যাটা ব্যাটা ফ্লেভারের
ব্যাটাদের মতো হাঁটিস- কাশিস- হাসিস
ভাল লাগে না তোর সাথে একটা মুহূর্ত
তবুও ঘুম আসে না তোর মুখটা চোখে না ভাসলে
আমার দিন কাটেনা একটা দিন তোকে না দেখে
আমার সময় গুলো
বুকের সবটুকু জমিন তুই দখল করে নিয়েছিস নীলা
বরষার জলে প্রথম তোর কাছে আসা
মনের ভিতরে টুকরো টুকরো করে তোকে গড়া
কেন আজ আমার সময় গুলো
তোর সাথে বাঁধতে ইচ্ছে করে
কেন আমার জীবনটা তোর হাতে তুলে দিয়ে
বলতে ইচ্ছে করে, "সাজিয়ে দে নীলা
তোর যেমন ইচ্ছে সেভাবে সাজিয়ে দে"
জানি না ভালবাসা কাকে বলে
বুঝতে পারি না সেটা কেমন
কেন তুই আমার জীবনে আসার পরে
আমার সবকিছু অন্যরকম লাগে
তোর হাতেই বন্দি আমার সময়ের সুতো
তোর চোখেই মিশে আছে আমার সবটুকু সুখ
জানি না তুই কে আমার
কেন এভাবে দখল করে নিলি আমায়
তুই একবার আমার বুকের মাঝে মিশে কি বলবি
তুই আমার কে?"

নাজনীনের দুই হাত কাঁপছে। ঠোঁটটা তরতর করে কাঁপছে। দু'চোখ দিয়ে অবিরত জল গড়াচ্ছে। সুখের জল। ভালবাসার জল। বুকের অনেক গভীর থেকে উঠে আসা জল। ও শুধু একটা কথাই ফিসফিস করে বলল, "তুই আমার সবকিছু স্টুপিড। তুই আমার সবকিছু। সবকিছু..."

তুই আমার কে? || শাকিল রনি
১৫ মার্চ ২০১৫

#শাকিল_রনির_পোস্ট_সমগ্র

No comments:

Post a Comment