Monday, August 19, 2024

হাসপাতালের বারান্দায় খুব উদ্ধত ভঙ্গীতে
দাঁড়িয়ে আছে তিতির। চেহারায় কেমন একটা
রুক্ষ,একগুঁয়ে, জেদী,দুর্বিনীত ভাব। দূর থেকে প্রথম
দেখায় যে কেউ ওকে ছেলে বলেই ভুল করবে।
কালো জিন্স,কালো শার্ট,বাঁ হাতে বড় ডায়ালের
ঘড়ি, ছোট ছোট চুল। কাছ
থেকে দেখলে কানের ছোট্ট ইয়ারিং আর নাকে
সাদামাটা নথ বোঝা যায়। তিতিরের বেশ বিরক্ত
লাগছে। ও সোজা
হয়ে দাঁড়াতেই চারপাশ থেকে কয়েকজন এগিয়ে
এলো।দেখেও সেটা উপেক্ষা করে করিডোর দিয়ে
হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো।ওর পেছন পেছন ওর
পাহারাদাররাও হাঁটছে। তিতিরকে আসলে তুলে
নিয়ে আসা হয়েছে। যাকে
ভদ্র ভাষায় বলে কিডন্যাপ । এ অবস্থায় অন্য
কোনো মেয়ে হলে ভয়ে চুপসে যেত।কিন্তু মেয়েটা
তিতির বলেই নির্বিকার। ওর পেছন পেছন যারা
হাঁটছে তাদের মাঝথেকে গাঁট্টাগোট্টা একজনকে
কাছে ডাকলো।বেচারা খানিকক্ষন ইতস্তত করে
এগিয়ে এলো।
-তোমাদের বস আমাকে হাসপাতালে আটকে
রেখেছে কেন?
-ভাবীর ডেলিভারি
-বউ থাকতে আবার আমাকে তুলে আনছে কেন?
লোকটা জিব কাটলো।
-বসের বউ তো আপনি হবেন। বড় ভাইয়ের বউয়ের
ডেলিভারি।
-তোমার বসের ফ্যামিলির সবাই কি গুন্ডা নাকি?
লোকটি আবারো জিব কাটলো।
-ভাবী যে কি বলেন।বসের বাবা জজ ছিল।মা
গৃহিণী। অন্যরাও খুব ভাল।
তিতির লোকটির শার্টের কলার চেপে দেয়ালের
সাথে ঠেসে ধরলো।অন্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই
বললো,
-আরেকবার ভাবী বলেছিস তো দাঁত ভেঙে দিব।
বসকে যেয়ে বল হাসপাতালে থেকে আমার গা ঘিন
ঘিন করছে।
ছাড়া পেয়েই মোটকু তিতিরের হাতের নাগাল
থেকে সরে গেল। বিড়বিড় করে বললো,
-বসের কপালে বহুত দুঃখ আছে এইবার
মোটকু ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই
আরেক চ্যালাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল।
-মুরাইদ্যা,বড় ভাবীর ছেলে হইছে। ছোট ভা...
মোটকু মুখ চেপে ধরে কানে কানে কিছু বললো।
দ্বিতীয়জন ঢোক গিলে বললো,
-আপারে ভেতরে নিয়া যা। আমি মিষ্টি নিয়া
আসি।
.
তিতির তের নম্বর বেডের কাছে এসে দেখলো
সুন্দরী একজন মহিলা শুয়ে আছে। বেডের পাশেই
ফাঁকা জায়গায় আরএফএলের টুলের উপর সুদর্শন
একটা ছেলে বসে আছে।এথলেটদের মত লম্বা,
ফর্সা। মাথা ভর্তি লালচে চুল। সবচেয়ে বেশি
চোখে পড়ে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি।খাটে শুয়ে থাকা
মহিলাটি জিজ্ঞেস করলো,
-পিয়াল পন্ডিত, এই কি তিতির?
ছেলেটি মাথা ঝাঁকালো। আচ্ছা তুমি বাইরে যাও।
ছেলেটি বাইরে যেতেই তিতির মহিলার বেডের
পাশে বসতে বসতে বললো,
-আমাকে কি এই শেয়াল পন্ডিতই ধরে এনেছে?
-শেয়াল পন্ডিত?
আচমকা বুঝে ফেলে হাসিতে ভেঙে পড়লো
পিয়ালের ভাবি।
-ভালই বলেছো ভাই।
-তোমার ছেলে হয়েছে। কনগ্রাচুলেশন।
-ধন্যবাদ ভাই। তা তুমি আমার এই দেবরটিকে বিয়ে
করবেতো ভাই?
-তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
-কেন?
-চিনি জা জানি না বিয়ে? এ দেখছি ওঠ ছেড়ি
তোর বিয়ে টাইপ হয়ে যাচ্ছে।
পিয়ালের ভাবীর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।জানে
পিয়াল দূরে যায়নি।দরজার ওপাশেই আছে। বেড
থেকে দরজা বেশি দূরে নয়।আর প্রাইভেট ক্লিনিক
হওয়ায় চিৎকার চেঁচামেচি নেই।পিয়াল তিনবছর
ধরে মেয়েটিকে ফলো করে। বাড়ির সবাই জানে।
এখন এই মেয়ে বেঁকে বসলে রেগে যে কি করে!
ভাবনা মনেই রইলো পিয়াল হনহনিয়ে হেঁটে এসে
তিতিরকে টেনে নিয়ে চললো।ভাবী পেছন থেকে
বললো,
-পিয়াল কি হচ্ছে?
-চিন্তা করো না ভাবী।ওকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি।
কাজি রেডি আছে।
পিয়ালের ভাবী দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
জোর করেই তিতিরকে বিয়ে করানো হলো।ওকে
যারা ধরে রেখেছিল একজনের গালে খামচির দাগ
বসে গেছে। কাজি চলে যেতেই তিতিরকে ছেড়ে
দিল।তিতির ঠাস করে পিয়ালের গালে চড় বসিয়ে
দিল।
পিয়ালের বাবা মা,বড় ভাই, মেজভাই, ছোটবোন
অবাক হয়ে তাকিয়ে গেল।তিতির দুপদাপ পা ফেলে
দোতালার একটা রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
পিয়ালের মেঝভাই আবীর চেঁচিয়ে উঠলো।
-গেল গেল।সব গেল।গেম অব থোর্নস -৭ দেখছিলাম।
গেল সব ভেস্তে।
পিয়ালের বড় ভাই মজিদ হেসে ফেললো।বাবার
দিকে তাকিয়ে বললো,
-বাবা,বাড়িতে বহুদিন পর আনন্দ ফিরে আসতেছে
মনে হয়।পিয়ালের বাবাও মৃদু
হেসে মাথা নাড়িয়ে সাঁয় দিল।
পিয়াল রেগে বেরিয়ে যেতেই হেসে উঠলো সবাই।
ছোটবোন রুনু বললো,
-আমি ঝুনু আপাকে ফোন করে আসি।
মা বললো,
-অকর্মাটা যোগ্য একটা মেয়েকেই বেছেছে। ঘর
আমার পূর্ণ হবে এবার।
-আমার গেম অব থোর্নস?
বাবা ধমক দিল,
-চুপ কর গাধা।
.
রুনু ফোনে কথা বলছে ঝুনুর সাথে।
-বলিস কিরে?সবার সামনে একেবারে চড় মেরে
বসলো?
-হ্যা আপা
-গ্রেট রুনু। গ্রেট। ভাইকে এইবার মানুষ করার লোক
চলে আসছে।
-ঠিক বলছো আপা ।
-আমার তো এক্ষুনি ভাবীর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে
করছে। কিন্তু তোর দুলাভাইয়ের ছুটি নাই।আর
কয়েকদিন পরেই শীতের ছুটি।তখন আসবো রে ।
-সে তো সামনের মাসে।
-কি করবো বল?
-আচ্ছা তুমি ধীরে সুস্থে আসো।
-ওকে।
.
তিতির দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভাবছে ।
ছোটবেলাতেই ওর বাবা মা মারা গেছে। চাচার
বাসায় থেকেই বড়। চাচীর মুখ কালো দেখতে
দেখতে সয়ে গেছে। তবুও অনার্স পর্যন্ত নিজের
বৃত্তি আর টিউশনির টাকায় পড়েছে। কিন্তু হঠাৎ
করে কি থেকে কি হয়ে গেল?
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা এসে
গেছিলো।দরজায় নক হতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
-কে?
-তিতির মা
তিতির আন্দাজ করলো শেয়াল পন্ডিতের বাবা।
দরজা খুলে দিল।
হুম। ওর বাবাই।উনি তিতিরের মাথায় হাত রেখে
নরম কন্ঠে বললো,
-মা, আমার ছেলে না হয় ভুল করেছে । এই বুড়ো
বাপটাকে মাফ করা যায় না?
বহু, বহুদিন পর তিতিরের সাথে এত সুন্দর করে কেউ
কথা বললো। তিতিরের শক্ত খোলস কোথায় গেল!
তিতির বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না
শুরু করলো ।তিতিরকে কাঁদতে দিল।তিতির সম্পর্কে
বাড়ির সবাই জানে।তিতির শান্ত হয়ে বাবাকে
বললো,
-আমি তোমাদের সবাইকে মেনে নিব।শেয়াল
পন্ডিতকে নয়।
পিয়ালের বাবা মা ভাই বোন সবাই উচ্চস্বরে হেসে
উঠলো।
.
পিয়ালের পরিবারের সাথে তিতিরের খুব
দ্রুতই সখ্যতা হয়ে গেছে। স্নেহের কাঙাল তিতির
যেমন পেয়েছে অঢেল ভালবাসা তেমনি বাড়ির
সবাই নিশ্চিত তিতিরকে পেয়ে। কখন কার কি
লাগবে সব একেবারে তিতিরের নখদর্পণে । মুখ ফুটে
চাওয়ার আগেই তিতির সামনে হাজির। বড় ভাবীকে
তো কিচ্ছুটি করতে
দেয় না।এমনকি বাচ্চাটিকেও সামলে রাখে
তিতির।
বিকেলে বাড়ির ছাদে বসে গল্প করছে সবাই।
যথারীতি পিয়াল নেই।বাচ্চাটা তিতিরের কাছে।
রুনু বললো,
-ভাবী, তোমার বাচ্চারে ছোট ভাবী যেভাবে আদর
করে । বড় হলে বাচ্চা তোমাকে আন্টি বলবে, ছোট
ভাবীকে আম্মু ডাকবে।
হেসে উঠলো সবাই।
.
এত্ত আনন্দ,এত্ত ভালবাসার মধ্যে দুরত্ব থেকেই
গেল। পিয়াল আর তিতিরের। একই ছাদের নীচে,একই
ঘরে দুটি মানুষ পাশাপাশি আছে। কেউ কারো
সাথে কথা বলে না। যেন দুটিতেই রোবট। পিয়ালের
ভীষণ ইচ্ছে হয় তিতিরের সাথে কথা বলতে।তিতির
কত সুন্দর করে সবার সাথে কথা বলে, অথচ তার
সাথে কেমন রোবটের মত আচরন করে। পিয়াল গিয়ে
ধরলো আবীরকে।
-ভাইয়া
-কি?
-তিতিরের সাথে মিল করিয়ে দাও না
-পিয়াল
-হ্যা ভাইয়া?
-তুই কি আমার মান সন্মান রাখছিস?
-মানে?
-আমি তোর মেঝভাই।আজ পর্যন্ত আমি কোনো
মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম
না।আমি যে একটা ছেলে বিয়ে করিনি সেই
বিষয়ে ভাবনা নাই কারো।আর তুই?
পেছন থেকে হাসির শব্দ শুনে তাকালো দুজনেই। বড়
ভাই।
-ভাইয়া তুমি?
-তোদের কাছেই আসছিলাম
-কেন?
-পিয়ালের একটা কিছু গতি করতে। সাথে তোরও।
-কি সেটা?
-আমার কলিগের বোন আছে। ভদ্র মেয়েটি।বেশি
পড়াশোনা জানা নয়। তোদের বড় ভাবীর মত। তো
মেয়েটিকে আমার আর তোর ভাবীর পছন্দ। পিয়াল
আর তিতিরকে পাঠাতে চাচ্ছিলাম।মেয়েটি
শুনেছি বেড়ার ওদিকে থাকে। তিতিরকে রাজি
করাবো আমি। কিন্তু মিল করবে পিয়াল।
দুই ভাই লাফিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো বড় ভাইকে।
.
-তিতির
-জ্বি ভাইয়া
-আবীরের জন্য একটি মেয়ে দেখেছি।তুমি
মেয়েটিকে কাল দেখে এসো।
-আচ্ছা ভাইয়া। রুনুকে নিয়ে যাব।
-নায়ায়ায়া
পেছন থেকে চিল্লিয়ে উঠলো আবীর।
-ইয়ে মানে রুনু কাল আমার সাথে এক জায়গায়
যাবে। তোমার সাথে পিয়াল যাবে।
তিতির বাধ্য হয়েই রাজি হলো। তিতির চলে যেতেই
তিন ভাই হাই ফাইভ দিল একসাথে ।
.
এক মাসে এক দিনও কথা বলেনি তিতির পিয়ালের
সাথে। পিয়াল পড়া কমপ্লিট করেছে ইংরেজি
নিয়ে। কিন্তু চাকরি না করে গুন্ডামি করে বেড়ায়।
গাড়ি পাবিপ্রবি ছাড়িয়ে যেতেই পিয়াল কথা শুরু
করে।
-তিতির
-
-তিতির, একটা মাস তুমি আমার সামনে আছো। কথা
বলো না। আমার ভীষণ কষ্ট হয়।
-
-আমি তোমাকে প্রথম দেখি এডওয়ার্ড ক্যাম্পাসে।
কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া হাতে বসে
ছিলে একা। তোমার আশেপাশে জোড়ায় জোড়ায়
অনেকেই ছিল।অথচ তুমি একা ছিলে। সেই প্রথম
দেখাতেই মুগ্ধ হই।তোমাকে ফলো করে তোমার
বাসা চিনে আসি।তিনবছর প্রতিটি দিন তোমাকে
একবার হলেও দেখেছি।
-ভাল। কিন্তু আমাকে এভাবে বিয়ে করার কারন
কি?
-তুমি তো কোনো ছেলের সাথে কথা বলতা না।
সেদিন ক্যাম্পাসে ওই লম্বা ছেলেটির সাথে
হেসে কথা বলতে দেখেই তো মাথায় আগুন ধরে
গেছিলো ।
তিতির মাথায় হাত দিল।
-ইয়া খোদা! ওইটা আমাদের এক্সটারনাল টিচার
ছিল।গেস্ট টিচার। উনি বরিশাল থেকে এসেছিল।
সচারচর আমার খুব বেশি টিচারের টিচিং
ভালোলাগে না।ওই টিচারেরটা ভাললাগছে সেটা
বলছিলাম স্যারকে।
পিয়াল জিব কাটলো।
-স্যরি তিতির
-এখন স্যরি বলে কি হবে?
-আচ্ছা আমার এই ভুলের জন্য তুমি তো একটা
ফ্যামিলি পেয়েছো।
-হ্যা
-তাহলে মাফ করা যায় না?
তিতির হেসে ফেললো। পিয়ালকে ইদানীং ওর
নিজেরও ভাল লাগতে শুরু করেছিল।
-হু
-তাহলে
-তাহলে কি?
-তোমার হাতটা ধরি?
তিতির আবার হেসে ফেললো।নিজেই পিয়ালের
হাত ধরলো।
-তিতির
-উঁ
-ছেড়ে যাবা না তো?
-বুঝতেছি না
-মানে কি?
-মানে হলো তুমি মানুষটা রোমান্টিক কিনা সেটা
না বুঝেই কেম্নে বলি?
এবার দুজনেই হেসে ফেললো।
-তুমি দুষ্টু আছ বেশ!
-আমিও জানতাম না গুন্ডাটা ভন্ড।
-মানে?
-তুমিও বেশ ভাল।
পিয়াল তিতিরের হাতটা একটু শক্ত করে
ধরলো।
হয়তো বোঝাতে চাইলো এভাবেই সম্পর্ক এভাবেই
টিকিয়ে রাখতে হয়।।
-ইশরাত জাহান

No comments:

Post a Comment