Monday, August 19, 2024

আনিস বিরক্ত হয়েই বসে আছে। ওর মামা মেয়ের
বাবার
সাথে হেসে হেসে গল্প করছে। আনিস সেদিকে
মনোযোগ দিতে পারছে না। ওর বিরক্তির কারন
দুটি।এক
পাত্রী দেখতে এসে প্রায় দেড় ঘন্টা বসে আছে।
অথচ
পাত্রী আসে নি।দ্বিতীয় কারন ওর পাঞ্জাবি।
মামী
জোর করে নতুন পাঞ্জাবি পড়িয়ে দিয়েছে। নতুন
পাঞ্জাবির কড়কড়ে ভাব ওর পছন্দ হচ্ছে না।
ভেতর থেকে কারো আসার সাড়া পেয়ে স্থির হয়ে
বসলো আনিস।
মেয়ের মা এসেছে। এসেই মামাকে বললো
-মেয়ে আসছে
আনিস উৎসুক হয়ে দরজার দিকে তাকালো।যদিও
বিয়ের
পাত্র পাত্রী দেখতে আসলে লজ্জাভাব নিয়ে
থাকে।
কিন্তু আনিস তা করলো না। ও তাকিয়ে আছে
মেয়েটাকে দেখার জন্য।
মেয়েটি প্রথমে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো।
আনিস
ভীষণভাবে চমকালো।
মেয়েটি ভীষণ মায়াবি।সাদা মাটা ঘরে পড়া
সুতির
শাড়ি পড়া। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া।
আর কিচ্ছু না। সম্পূর্ণ নিরাভরণ। মেয়েটি আনিসের
মামাকে সালাম দিল।আনিস মেয়েটির নাম মনে
করার
চেষ্টা করলো।হ্যা। মীরা। মেয়েটির নাম মীরা।
আনিসের মামা মীরার বাবাকে বললো,
-মেয়েকে আমি প্রথমেই দেখেছি।ওরা দুজন একটু
কথা
বলুক।
মীরার বাবা বললো,
-নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
মীরার মা বললো,
-মীরা, উনাকে ছাদে নিয়ে যা।
.
মীরাদের বাড়ির ছাদটা বেশ সুন্দর। একতলা বাড়ি।
ছাদের উপর প্রচুর গাছ। কয়েকরকমের গোলাপ,
বেলি,
রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া সহ আরো অনেক
ফুল।
মাটি ছাদে তুলে লেবু গাছও লাগানো হয়েছে।
লেবুর
পাশাপাশি সবজি আছে কয়েক জাতের।
একপাশে বসার জায়গাও আছে। আনিস চুপচাপ
দেখছে।
মীরাও চুপ করে আছে কিন্তু ও আনিসকে দেখছে।
আচমকাই আনিস মীরাকে বললো,
-আপনি চোখে কাজল দিলে বেশ লাগতো।
বলেই লজ্জা পেল। মীরার মুখ দেখে কিছু বোঝা
গেল
না।
কিছুক্ষন পর আনিস নিজেই আবার বললো,
-আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
মীরা এবারও চুপ।
আনিসও কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে বললো,
-চলুন নীচে যাওয়া যাক।
আনিস মামাকে জানিয়ে দিল মীরাকে ওর পছন্দ
হয়েছে।
.
আনিসরা চলে যেতেই মীরার মা মীরার বাবাকে
বললো,
-আচ্ছা,এইরকম চালচুলোহীন ছেলেকে তুমি
কিভাবে
পছন্দ করলে?
মীরার বাবা দুলে দুলে হাসছে। মীরার মা ভীষণ
ক্ষেপে
গেল।
-হাসবা না। কথার উত্তর দাও।
মীরার বাবা আচমকাই গম্ভীর হয়ে গেল।
-রেহানা, আমাদের বিয়ের কথা মনে আছে?
-থাকবে না কেন?
-বিয়ের সময় কিন্তু আমিও চালচুলোহীনই ছিলাম।
অল্প
মাইনের একটা চাকরী করতাম।তুমি তবুও তোমার
বাবার
অর্থ বৈভব ছেড়ে চলে এসেছিল।আজ দেখ আমাদের
হয়তো অত টাকাপয়সা নেই। কিন্তু সুখ আছে। তাহলে
মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবছো কেন?মেয়ে তো
তোমার
একার নয়।
মীরার মা লজ্জা পেল।ঠিকই তো।সাতাশ বছর ধরে
যে
লোকটির সাথে সে বাস করছে সে তো ভুল
সিদ্ধান্ত
নেবে না।তবুও গাঁইগুঁই করে বললো,
-আজকালকার প্রফেসররা কতই বা বেতন পায় বলো।
তাও
আবার সরকারি,বদলির চাকরি।
-ভেবোনা তো অত।মেয়ে আমাদের সুখেই থাকবে
দেখো।
যাও তো, কড়া করে দুকাপ চা করে আনো।বিয়ের
বাজার। লিস্টিটা করে ফেলি।
.
মীরা ঘরে যেয়ে রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে দিল।
আবীরের
গলায় বেজে চলেছে,
'আমার বেলা যে যায়
সাঁঝ বেলাতে
তোমার সুরে সুরে
সুর মেলাতে
আমার বেলা যে যায় '।
মীরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সযত্নে
চোখে
কাজল লাগায়।মীরা জানে, ওর গায়ের রং একটু
চাপা
হলেও চোখ দুটি ভীষণ সুন্দর।ও ইচ্ছে করেই সাদা
মাটা
ভাবে গেছে। কারন আনিসের পেশা শুনেই মীরা
বেঁকে
বসেছে। দর্শনের প্রফেসর। মীরা ভেবেছিল ওর বর
হবে
ভীষণ রোমান্টিক। জোৎস্না হলেই যে বলবে 'মীরা
চলো
ঘুরেআসি '।শেষে কিনা এই আধবুড়ো লোকটাকে
বাবা
পছন্দ করেছে! মীরার ভীষন কান্না পেল।
.
তেরই কার্তিক মীরা আর আনিসের বিয়ে হয়ে গেল।
বাসর
মামার বাসাতেই করার কথা ছিল।আনিসের
জোরাজুরিতে আনিসের বাড়িতেই হলো।বাড়িটা
মীরার পছন্দ হলো দেখেই।সেকেলে বনেদি বাড়ি।
বাড়ির সামনে বিশাল ছাতিম গাছ।একপাশে
বাগান।
মীরা মুগ্ধ হয়ে গেল।
.
কয়েকদিন লেগে গেল মীরার সবকিছু গুছিয়ে নিতে।
এত
বড় বাড়ি অথচ লোক নেই।বেশিরভাগ ঘর তালাবন্ধ।
মীরা
দুজন কাজের লোক রেখে দিল।
সারাদিন মীরা ব্যস্ত থাকে বাড়ি আর বাগান
নিয়ে।
আনিস ব্যস্ত ভার্সিটি নিয়ে।
বিকেলে মীরা যখন বাগানে হাঁটে ,আনিসের ইচ্ছে
করে
মীরার পাশে হাঁটতে।
লজ্জা, দ্বিধায় পারে না। মীরা হয়তো তাকে
ঠিক পছন্দ করে না।
মীরা আনিসকে বারান্দায় দেখলে ভাবে নীচে
আসতে
বলবে।মীরার লজ্জা করে।সেই দেখতে যেয়ে যে
কথা
বলেছিল।তারপর আর তেমন কথা হয়নি বিয়ের পর।
হ্যা না
তেই কথা শেষ করে অথবা পারতপক্ষে কেউ কারো
সাথে
কথাই বলে না।
.
শীত খুব জাঁকিয়ে পড়েছে এবার। আনিস এখনো
আসে নি।
কখনো এত দেরী করে না। মীরা অস্থির হয়ে
পায়চারী
করছে। আব্দুল এসে খবর দিল স্যার আসছে।
মীরা নীচে গেল।আনিস শীতে কাঁপছে ঠকঠকিয়ে।
মীরা বললো,
-আপনি বাথরুমে যান, আমি গরম পানি দিচ্ছি।
আনিস মাথা নেড়ে চলে গেল।
ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে কাঁচুমাচু করতে
লাগলো।
-আপনি কি কিছু বলবেন?
আনিস ইতস্তত করে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল মীরার
দিকে। মীরা অবাক হলো।কিছু না বলে খাবার
এগিয়ে
দিল।পালং শাক ভাজি,মসুর ডাল ভুনা,শুকনা মরিচ
তেলে ভেজে মচমচে করা, গরম ভাত, ঘি।আনিস বেশ
তৃপ্তি করে খাচ্ছে। খাওয়া শেষে উঠে যাওয়ার
আগে মৃদু
কন্ঠে বললো,
-আজ হঠাৎ দেখেই আপনার কথা মনে পড়লো।আপনার
পছন্দ হবে কি না জানিনা।
মীরা সব গুছিয়ে রেখে রুমে এসে ব্যাগটা খুললো।
খুলে
অবাক হলো।ব্যাগের মধ্যে তসরের একটা শাড়ি,
সাদা
রেশমি চুড়ি, কালো টিপ আর কাজল রাখা।
মীরার মন হঠাৎ করেই ভীষন ভালোলাগায় ভরে
গেল।
.
সকাল সকাল মীরা আনিসকে ডেকে তুললো।
-শুনছেন?
আনিস প্রথমে বোঝে নি। তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে
বসলো।
চোখ মুছতে মুছতে বললো,
-ডাকছিলেন?
-হ্যা
-কোনো সমস্যা?
-হ্যা ।একটু আসুন ।
আনিস মীরার পিছু পিছু রান্নাঘরে গেল।মীরা
আনিসকে বসিয়ে গরম গরম ভাপা পিঠা সামনে
এগিয়ে
দিল।
আনিস বললো
-মুখ ধুয়ে আসি?
-ভাপা পিঠা মুখ ধুয়ে খেলে মজা লাগে না
বলেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে ফেললো মীরা।
দুমুহূর্ত পর আনিসও হেসে ফেললো।
.
আনিস আর মীরার সম্পর্ক এখন অনেকটাই সহজ।
হালকা
কথাবার্তা, হাসি ঠাট্টা হয়।
জোৎস্না এমনিতেই সুন্দর হয়।কিন্তু শীতের
জোৎস্নাগুলো যেন মারাত্মক সুন্দর হয়।
আনিস মীরাকে বললো,
-বাইরে যাবা?
-কেন?
-আজ পূর্ণিমা। বাইরে দেখ ভীষণ সুন্দর জোৎস্না।
-চলো।
মীরা শালটা টেনে নেয়।
বাইরে হাঁটতে বেশ ভালই লাগছিল মীরার। হাঁটতে
হাঁটতে বেশ অনেকটা দূর চলে এসেছে। সামনে
ছোট্ট
একটা স্টল খোলা।
-মীরা চা খাবা?
-হু
-চলো।
আনিস দোকানটিতে যেয়ে চা দিতে বলে।
চা নিয়ে মীরা চুপ করে বসে আছে খেয়াল করে
আনিস
বললো,
-কি হয়েছে মীরা?
মীরা মাথা নিচু করে বললো,
-তুমি এই কাপ থেকে এক চুমুক চা নাও।
আনিস মীরার দিকে চা এগিয়ে দিল।
মীরা চায়ে চুমুক দিচ্ছে হাসিমুখে।কি সুন্দর লাগছে
মীরাকে দেখতে। আনিস তাকিয়ে আছে।
.
আনিস আর মীরা পাশাপাশি হাঁটছে। মীরা
আনিসের
হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে
চাঁদের আলোয়।কুয়াশামাখা আলোয় অপার্থিব
লাগছে
সব কিছু।হতাশা,বঞ্চনা, শোষনের পৃথিবীকে এত
সুন্দর
করার দরকার ছিল কি??
-ইশরাত জাহান

No comments:

Post a Comment