Saturday, February 18, 2017

ধন্যবাদ কিউপিড!

(ঈদ স্পেশাল)
ধন্যবাদ কিউপিড!
লেখাঃ ফারজানা সিদ্দিকী
নম্রতা
.
কলিং বেল এর আওয়াজ শুনে ঘুম
ভেঙ্গে
গেলো স্বপ্নিল এর।এমনিই রাতে
লোডশেডিং এর
জন্য ঠিক মতো ঘুমাতে
পারেনি,তারউপর এই সাত
সকালেই কে যেন এসে হাজির।
ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে দেখে সাড়ে ছয়টা
বাজে। একটু পরেই
তাকে উঠতে হবে,তবুও বিছানা
ছেড়ে উঠতে
প্রচণ্ড আলসেমি লাগছে। প্রথমে
উঠতে না
চাইলেও পড়ে কিছুটা বিরক্ত হয়েই
দরজা খুললো।
চোখ থেকে ঘুমের রেশ তখনো না
কাটলেও
দরজা খুলে দাড়িয়ে থাকা
মানুষটিকে দেখা মাত্র ঘুম
তার তল্পিতল্পা নিয়ে মামা
বাড়ি পালিয়েছে।
দাড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেও
নয়, সপ্নীলদের
বাড়িওয়ালা। আসলে
বাড়িওয়ালী। নাম হাস্না বেগম
হলেও তিনি আসলে ঘষেটি বেগম!
চার ইউনিটের
এই বিশাল ছয় তলা বাড়ির মালিক
হওয়ায় নিজেকে মহারানি
ভিক্টোরিয়া মনে করেন। স্বামী
নেই,দুই
ছেলে আলাদা বাসায় থাকে, বড়
মেয়ের বিয়ে
হয়ে গেছে আর ছোট মেয়ে
অস্ট্রেলিয়াতে
পড়াশুনা করছে। এই মহিলার নিয়ম
আবার সম্পূর্ণ আলাদা।
সব বাড়িওয়ালা যেমন মাসের
শুরুতেই ভাড়া নিয়ে
নেয়। তিনি তা করেন না। সারা
মাস ছেলেমেয়ের
বাড়িতে বাড়িতে আয়েশ করে।আর
মাস শেষে
যখন সবার বেতন-ভাতা ফুরিয়ে
ফকিরা অবস্থা হয় তখন
সাত দিন আগে এসে হাজির হয় এই
বাসায়। ভাড়া না পাওয়া
পর্যন্ত বিরক্ত করতেই থাকে। প্রথম
মাসে
বেপারটা বুঝতে না পারায় অনেক
ঝামেলা সহ্য
করতে হয়েছিল। তাই এখন মাসের
শুরুতেই ভাড়ার
টাকা আলাদা ভাবে সরিয়ে
রাখে। হাস্না বেগম কে
দেখেই সালাম দেয় সপ্নিল।
সালামের উত্তর না
দিয়েই হাস্না বেগম বলে উঠে,
- “এই যে ছেলে কি নাম যেন?”
- “জ্বী! সপ্নিল”
- “নাম যাই হোক। মাস তো শেষ
প্রায়। ভাড়া
কই,হ্যা?”
- “জ্বী আজকেই বিকালে আপনাকে
দিয়ে
আসতাম। তবে আপনি নিজেই চলে
এলেন আর কি”
- “ও! তো আসছিই যখন ভাড়াটা
দিয়ে দাও”
- “এক্ষুনি আনছি। আপনি ভিতরে এসে
বসুন”
- “না ভিতরে বসব না। তুমি
তাড়াতাড়ি টাকা নিয়া আসো।
উপরে যেতে হবে আবার”
সপ্নিল টাকা এনে হাতে দাওয়ার
পর হাস্না বেগম টাকা
গুলো তিন বার গুনে। তারপর ঘরের
ভিতর কিছু একটা
দেখে, “এসব কি?” বলে চিল্লিয়ে
উঠে।
ভেবাচেকা খেয়ে পিছনে
তাকিয়ে দেখে
দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির
ফ্রেম, সপ্নিল
আর তার বউ অনামিকার।
- “জ্বী আমার আর অনামিকার ছবি”
- “ছবি তো আমিও দেখতে
পাইতেছি। দেয়ালে
টাঙ্গাইছ কেন? দেয়াল ফুটা করছ
কেন?”
- “ফুটা না করলে ছবি টাঙ্গাবো
কেমনে?”
- “চুপ!বেয়াদব ছেলে! একে তো
আমার বাড়ির
দেয়াল ফুটা করছ আবার তর্ক কর? পরের
মাসে ভাড়া
বাড়ায় দিবা এক হাজার টাকা”
- “আশ্চর্য!মানে কি এসবের?একে তো
মুরগির
ঘরের মতো ছোট একটা ঘর, ঠিকমতো
পানি
আসে না। তাও অনেক ভাড়া দেই।
আর এই সামান্য
দেয়াল ফুটা করার জন্য এক হাজার
টাকা বাড়ায়
দিতেছেন আপনি? ফাইজলামি?
পাগল আপনি?”
- “এই ছেলে খবরদার বেশি কথা কইবা
না। আমার বাড়ি
আমি যা কইব তাই হইব। হয় ফুটা ঠিক
কইরা দিবা, নাহলে
যতদিন ফুটা থাকবো ভাড়া
বাড়াইয়া দিবা”
- “আচ্ছা আমি ঠিক করে দিব আজ-
কালকের মধ্যেই”
- “সেইটাই জানি হয়”
কথাগুলো বলে চলে গেলো হাস্না
বেগম।
রাগে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে
দিল সপ্নিল। এই সাত
সকালে এসবের কোন মানে হয়?
মহিলা টা যখনি মুখ
খুলে তখনি তার কর্কশ গলা দিয়ে
চিরতার মতো
তেতো কথা বের হয়। দিনটাই
খারাপ যাবে মনে
হয়। মাথার ভেতর মনে হচ্ছে মগজটা
রাগে সেদ্ধ
হচ্ছে। পিছন ঘুরেই দেখে অনামিকা
চুপ করে
দাড়িয়ে আছে। চোখ দুটো ছলছল
করছে তার।
আস্তে করে ছবিটা নামিয়ে নিয়ে
রুমে চলে
গেলো। সপ্নিল যেয়ে দেখে
মেয়েটি চুপ
করে ছবিটা নিয়ে খাটের উপর বসে
আছে। কিছু
একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো
সপ্নিল। কি
বলবে সে আসলে বুঝতে পারছে না।
নিজের
মতো তৈরি হতে থাকলো। কিছুক্ষণ
পর অনামিকা
নিজেই ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আজকেই
পুডিং এনে দেয়ালটা ঠিক করে
দিস। আমার কাছে এই
দেয়ালের রঙ আছে। করে দিব”
প্রতিউত্তরে
সপ্নিল শুধু “হুম” বলে বাসা থেকে
বেড়িয়ে
গেলো কাজের জন্য।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায়
অমনোযোগী
সপ্নিল। সারাদিন শুধু বাঁদরামি
করতো । অতিষ্ট হয়ে
যখন তার বাবা লাঠি নিয়ে মারতে
আসতো,তখন দৌড়ে
মায়ের আঁচলে আশ্রয় নিত। বিশ্ব
ফাঁকিবাজ হওয়ায়
কখনই পরীক্ষার ফলাফল ভালো হতো
না। তাই
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরে
থাক, ভাগ্যে
কোনরকম একটা বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয় জুটেছে।
সপ্নিল তার নামটার মতই কাব্যিক।
সপ্ন দেখতে
ভালোবাসতো, কবিতা লিখতে
ভালোবাসতো,
উপন্যাস পড়ে অবাক হতে
ভালোবাসতো সে।
কিউপিডের প্রতি তার বিশাল
ভক্তি! ছোট পাখাওয়ালা
মোটাসোটা অদৃশ্য একটা এঞ্জেল
কি একটা তীর
ছুরে মারে, আর বোকা মানুষ গুলো
কি উদ্ভট
কাণ্ডগুলাই না শুরু করে প্রেমে পড়ে।
কলেজ
থেকেই সুন্দরী মেয়ে দেখে তাকে
নিয়ে
কবিতা লিখে ফেলার বেশ সুনাম
ছিল সপ্নিলের।
বিশ্ববিদ্যালয়েও এই গুণে সে দ্রুতই
জনপ্রিয় হয়ে
গিয়েছিল। পড়াশুনায় যাই থাকুক না
কেন কয়েকটা গুণে
সে গুণান্বিত ছিল। খুব ভালো
কবিতা লিখতে
পারতো, ভালো গিটার বাজাতে
পারতো, ভালো
গানও গাইতে পারতো ছেলেটা।
তাই বন্ধুদের
আড্ডায় সপ্নিলের থাকা চাই চাই।
নতুন নতুন ক্লাস শুরু হওয়ার প্রায় ১০-১২
দিন পর একটি
নতুন মেয়ে এসেছিল ক্যাম্পাসে।
তার টানা
চোখের মায়াবী চাহনি তার
সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়
বহুগুনে। বিদেশে পরতে যাওয়ার
কথা ছিল। কিন্তু
কোন কারনে তা না হওয়ায় এতদিন
পর এখানে ভর্তি
হয়েছে। প্রথম দিন মেয়েটিকে
দেখেই
সপ্নিলের খুব ভালো লেগেছিল।
অবাক হয়ে
চেয়েছিল। কি সুন্দর মেয়েটা, ঠিক
যেন তার
সপ্নের অপ্সরী! ক্লাসে গিয়ে আরও
অবাক
হয়েছিল। মেয়েটিতো তারই
ডিপার্টমেন্ট এর। সারা
ক্লাস মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকেই
দেখেছিল। এভাবে
দিন চলতে থাকে। যেই ছেলে
সকালের সব
ক্লাস মিস করতো, সে তখন সাতটার
সময় গিয়ে
বসে থাকতো শুধুমাত্র মেয়েটিকে
দেখার জন্য।
কথা বলার সাহস পায়নি কখনো।
নামটাও জানতে
পারেনি।
একরাতে মেয়েটিকে নিয়ে
কবিতা লিখতে বসে
গিয়েছিল। কিন্তু কিছুই লিখতে
পারছিল না। মেয়েটির
কথা চিন্তা করলেই কেমন যেন
লাগে। এক অদ্ভুত
অনুভুতি। আগে তো এমন হয় নি। সপ্নিল
বুঝতে
পেরেছিল যে কিউপিড তার
ভালোবাসার তীরটা
এবার ঠিক সপ্নিলের বুকে ছুঁড়ে
মেরেছে। এখন
এটা থেকে পালাবার আর উপায়
নেই। কিন্তু
মেয়েটার নামই তো জানত না।
মেয়েটির বন্ধুরা
তাকে লাট্টু বলে ডাকতো। আর
বাকিদের
জিজ্ঞেস করলে বলত “নবাবের
কন্যা”। সপ্নিল
ভাবে একটা নাম তো দিতেই হয়।
সারারাত চিন্তা করে,
কাগজের পর কাগজ নষ্ট করে তার সেই
সপ্নের
অপ্সরীর নাম দিয়েছিল অনামিকা।
পরের দিন অনেক সাহস নিয়ে কথা
বলেছিল
মেয়েটির সাথে। পিছন থেকে
অনামিকা বলে ডাক
দেওয়ার সাথে সাথে মেয়েটি
ঘুরে বলেছিল,
- “জ্বী বলুন”
- “আসলে আমরা একি ডিপার্টমেন্ট
এ। কিন্তু
তোমার নামটা তো জানা হল না।
কখনো দরকার
পরলে তো দূর থেকে ডাকতেও পারব
না। নামটা
যদি বলতে? আমি সপ্নিল বাই দা
ওয়ে”
- “আপনিই তো আমাকে
ডাকলেন,রাইট?”
- “জ্বী আমিই”
- “তাহলে? ফাইজলামি করছেন?”
- “না না তা করবো কেন? আমি তো
ডাকলাম শুধু
পরিচিত হতে। মানে তোমার
নামটা তো জানি না। তাই
তোমার নাম আমি নিজেই
দিয়েছিলাম অনামিকা। তুমি
দেখতে অনেক সুন্দর তো। তাই, নাম
না জানা
সুন্দরি,অনামিকা”
- “আমার নাম অনামিকাই”
- “ওয়াও! কাকতালীয় ব্যাপার তো”
- “কিছু বলবেন? কোন দরকার ছিল?”
- “সপ্নিল নামের একটি ছেলে যদি
তার হাতটা বাড়িয়ে
দিয়ে বন্ধুত্ব চায়, অনামিকা কি
দিবে?”
- “একি ক্লাসে পড়ি। তো সেই
অনুযায়ী তো
ফ্রেন্ডই হই”
- “না মানে ভালো ফ্রেন্ড। আমি
ফাঁকিবাজ কিন্তু
ছেলেটা খারাপ না”
- “হাহাহা...ঠিক আছে”
সেই থেকে শুরু হয়েছিল তাদের
বন্ধুত্ব।
বন্ধুত্ব যে কখন ভালবাসায় পরিণত
হয়েছিল বুঝতেও
পারেনি অনামিকা। এমনি খুব শান্ত
হলেও, সপ্নিলের
সাথে রাজ্যের সব গল্পের ঝুরি
নিয়ে বসতো।
কথা যেন ফুরাতেই চায় না। কত
টাকা যে তারা
মোবাইল ফোন নামক অতি প্রিয়
বাক্সটার পিছে খরচ
করেছিল, তার আর হিসাব নেই। সেই
টাকা মোবাইল
কে না খাওয়ায় নিজেরা খেলে
এতদিনে বেশ
মোটাতাজা হয়ে উঠত। বড্ড
অভিমানী মেয়ে
অনামিকা। কোন কিছু নিজের মতো
না হলেই খুব
অভিমান করতো। আর এই অভিমান
ভাঙাতে কতকিছুই না
করতো সপ্নিল। তবে কখনই বিরক্ত হতো
না এই
অভিমানী রাজকন্যার অভিমান
ভাঙাতে।
একদিন খুব ভোরে অনামিকা কল
দেয়। ঘুম ঘুম
চোখেই ফোনটা ধরে সপ্নিল। ওপাশ
থেকে
অনামিকা বলে উঠে,
- “এখনও ঘুমাচ্ছিস? তাড়াতাড়ি
বাসায় আয়। আজকেই বাবা
কে সব বলবি। আমি কিছু জানি না।
সে কিন্তু আমার
বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে”
- “আমি আসব? আজকে?”
- “আজকে মানে এখন”
- “তুই কেন কিছু বলিস নাই তাকে? তুই
বল সব কিছু”
- “আমি তোর কথা বলছি। বলছে তোর
সাথে কথা
বলে দেখবে। ঠিকঠাক মনে হলে
ভেবে
দেখবে। তাই তুই এখনি সুন্দর মতো
রেডি হয়ে
বাসায় চলে আয়”
- “আজকে না আসলে হয় না?”
- “আমি কিছু জানি না। তুই যদি
বাবাকে সব না বলিস আমি
কিন্তু কিছু একটা করে ফেলবো”
- “ইয়ে মানে তোর বাসার নিচে
কুকুর আছে
তো!”
- “কুকুর? আমার থেকে তোর কাছে
কুকুর বেশি
ইম্পরট্যান্ট? অসহ্য”
- “না না ওটা বলি নাই তো। আচ্ছা
আসতেছি। রাগ
করে না সোনা”
বিছানা থেকে উঠে রেডি হয়ে
অনামিকার বাড়ির
পথে রওনা দিল। বেশ ফিটফাট হয়েই
গিয়েছিল। বাড়ির
গেটটা হাল্কা খুলার সাথে সাথেই
অনামিকাদের কুকুরটা
ঘেও ঘেও করে তেরে আসতে নেয়।
দারোয়ান না থাকলে সপ্নিল
নির্ঘাত সেদিন কুকুরের
খানদানি লাঞ্চ হয়ে যেত।
ড্রইংররুমে বসিয়ে
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে
দারোয়ান চলে
যায়। অনামিকাদের বাসায়
বারান্দা,রান্নাঘর আর বাথরুম
বাদে সব রুমেই এসি আছে।
চারদিকে তাকিয়ে
দেখতে থাকে। সব দামি দামি
জিনিস। যতই দেখে
ততই ভয় হয়। এক সময় চোখ বন্ধ করে বসে
রইল। অনামিকার বাবার কাশির
আওয়াজে চমকে উঠে
দাঁড়ায়,
- “আসসালামুয়ালাইকুম”
- “ওয়ালাইকুমআসসালাম। বস”
- “জ্বী ধন্যবাদ”
- “নাম কি?”
- “সপ্নিল। ফারদিন খান সপ্নিল”
- “বাড়ি কই?”
- “রাজশাহী। থাকি ঢাকাতেই”
- “বল দেখি তোমার পরিবার
সম্পর্কে”
- “জ্বী। পরিবারে বাবা,মা,বড় ভাই
আর আমি। বাবা
সরকারি চাকরি করেন। মা হাউজ
ওয়াইফ। বড় ভাই ডাক্তারি
পড়ে”
- “কোন ইয়ার এ তুমি?”
- “থার্ড ইয়ার এ উঠলাম”
- “ওহ! অনামির সাথেই। তা তুমি যে
ওকে বিয়ে
করতে চাও কামাই রোজগার কিছু কর?
ওর তো
মাসে শুধু হাত খরচই দশ হাজার টাকা
দেই”
- “না মানে আমরা এখন বিয়ে করতে
চাচ্ছি না। পড়াশুনা
শেষ করে তারপর”
- “আমি যে ওকে এখনি বিয়ে
দিব,সেটা কি বুঝতে
পারছ না?”
- “হ্যাঁ! তাহলে আমি পড়াশুনার
পাশাপাশি ছোট একটা চাকরি
শুরু করবো”
- “লাস্ট সেমিস্টার এ সিজিপিএ কত
তোমার?”
- “২.৩৫”
- “হেহে এই সিজিপিএ নিয়ে তুমি
ঝালমুড়ি বেচা অথবা
থালাবাসন ধুতে পারবা, চাকরি
না। শুনো,অনামিকা কে
পাওয়ার যোগ্যতা তোমার নাই।
তাই অযথা ঝামেলা কর
না। ওর সাথে আর যোগাযোগ কর না।
বিয়েটা হয়ে
গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে,
তোমাকে ভুলেও
যাবে। বুঝতে পারছ?”
- “জ্বী”
- “এখন আসতে পারো”
- “জ্বী!আসসালামুয়ালাইকুম”
বাসা থেকে বের হয়ে সপ্নিল যেন
হাফ ছেরে
বেঁচেছিল। কিছুক্ষণ পরই অনামিকা
কল এলো।
প্রথমে ধরবে না ভেবেও সে কলটা
রিসিভ করে,
- “হ্যালো”
- “বাবার সাথে কথা বলছিস?”
- “হুম”
- “কি বলল?
- “সম্ভব না”
- “তুই কি বলছিস?”
- “ঠিক আছে!”
কথাটা শুনেই ফোন রেখে
দিয়েছিল অনামিকা।
রাতে ফেসবুকে বসে সপ্নিল দেখে
অনামিকার
বার্তা। একটা লোকের ছবি এবং
তার সম্পর্কে
অনেকগুলো কথা। লোকটা
অনামিকার হবু জামাই।
দেখতে শুনতে ভালই, শুধু মাথায় টাক।
অনেক
শিক্ষিত। যুক্তরাষ্ট্রে একটা আইটি
ফার্মে চাকরি
করে, অনেক বেতন। সে রাতে সপ্নিল
আর
কোন উত্তর না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু ঘুমাতে
পারেনি সারারাত। সকালের
আলো ফুটা মাত্রই
অনামিকাকে ফোন দেয়,
- “হ্যাঁ বল। এতো সকালে?”
- “তুই ওই ছেলেটাকে বিয়ে করবি?”
- “হুম”
- “মাথায় স্টেডিয়াম তো”
- “ওতাই একটা সমস্যা। বাকি সব ঠিক
আছে। ব্যাপার না”
- “না!তুই ওই টাকলাকে বিয়ে করবি
না”
- “তো কি করবো? তুই তো আর করবি
না”
- “আমিই করবো। কেমনে কি জানি
না। শুধু জানি তুই
ওই টাকলার সাথে যাবি না। তুই
আমার”
- “সপ্নিল?”
- “বল”
- “চল ভেগে যাই। ভেগে বিয়ে করে
ফেলি”
- “তারপর? আব্বু মানবে নাতো।তারপর
কি করব?আমার
কাছে জমানো অল্প কিছু টাকা
আছে মাত্র”
- “চেষ্টা করবো। না মানলে
আলাদা বাসায় থাকবো।
আমার কাছেও জমানো অনেকগুলা
টাকা আছে। তুই
ছোট একটা কাজ নিবি,আমিও কিছু
করবো। দুইজন
মিলে হয়ে যাবে”
- “ঠিক তো?”
- “হ্যাঁ সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই এক কাজ
কর, তোর
জিনিসপত্র নিয়ে আমার বাসার
নিচে আয়। আমি বারান্দা
দিয়ে ওড়নায় বেঁধে আমার
ব্যাগগুলা দিব। তুই নিয়ে
দূরে গিয়ে দাঁড়াবি। পড়ে আমি
বাসা থেকে কিছু একটা
বলে বের হয়ে আসব। তারপর বাকি
কাজটা। তুই
আমাদের কিছু ফ্রেন্ডকে এখনি
ফোন দে,
সাক্ষীর জন্য”
- “আয় হায়! তোর বাসায় আবার? কুকুর
তো! তোর
জল্লাদ বাপ টাও তো আছে। খায়ে
ফেলবে
আমাকে”
- “উফ! অসহ্য! তুই বাসার পিছনে আমার
রুমের সাথে
যে বারান্দা ওটার নিছে আসবি।
এখন রাখলাম”
যেই বলা সেই কাজ। সিএনজি নিয়ে
সোজা কাজী
অফিস চলে যায়। কবুল বলার সময়
অনামিকা যতটাই
উচ্ছ্বাসিত ছিল, সপ্নিল ততটাই ভয়ে
ছিল। বিয়ের পর
অনামিকা প্রায় জোড় করেই সপ্নিল
কে নিয়ে একটা
সেলফি তুলেছিল। সেই ছবিটাই খুব
সখ করে বাধাই
করে এনে দেয়ালে
টাঙ্গিয়েছিল। আর এটা নিয়ে
কি কাণ্ডটাই তাই না করলো
বাড়িওয়ালী।
সপ্নিলের পরিবার মেনে নেয়নি
সেই বিয়ে। বাধ্য
হয়েই এমন একটা বাড়ি ভাড়া নিতে
হয়। শুরু থেকেই
খুব কষ্ট করে থাকছে তারা। বিয়ের
প্রায় এগারো
মাস হয়ে গেছে। এখনও মেনে
নেয়নি তাদের।
সপ্নিল একটা বিপনী দোকানে
সেলসম্যান হিসাবে
কাজ করে আর রাতে দুইজনকে গিটার
শিখায়।
এদিকে অনামিকা প্রতিদিন ব্যাচ
করে কিছু ছোট
ছোট বাচ্চা কে টিউশন দেয়। সব
মিলিয়ে যত টাকা
কামাই করে তা দিয়ে মোটামুটি
ডাল-ভাত খেয়ে মাস
চলে। কিন্তু বাসা ভাড়া, সপ্নিলের
পড়াশুনার খরচ এবং
বাকি সব খরচ মিলিয়ে বলতে গেলে
আর কিছুই
বাচে না। অনামিকা আর্থিক
অবস্থার কথা ভেবে
পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছে।
সপ্নিলের ভালো একটা
চাকরি হলে আবার শুরু করবে।
সপ্নিলের পড়া শেষ
করে ভালো একটা চাকরি পাওয়া
খুব দরকার। অনামিকার
দৃঢ় বিশ্বাস, ভালো একটা চাকরি
পেলেই ওদের সবাই
মেনে নিবে। এই বিশ্বাসের
জোড়েই সেই
প্রথম থেকে মেয়েটি সব কষ্টকে
হাসি মুখে
বরণ করে নিয়েছে।

রোজা রেখে,রোদের মধ্যে বাড়ি
বাড়ি ঘুরে
পণ্য পৌঁছে দিয়ে, প্রচণ্ড হয়রান হয়ে
একটি চায়ের
দোকানের পাশে বেঞ্চে বসে
আছে সপ্নিল।
প্রচণ্ড গরম আজকে, বাইরে গুমট উষ্ণতা।
মনটা খুব
খারাপ ওর। সকালে অনামিকার
উদাস মুখটি দেখে এখন
আর কিছুই ভালো লাগছে না তার।
ছোটবেলাতেই
তো ভালো ছিল। সারাদিন শুধু
বাঁদরামি করতো আর
বাবার হাতে মার খেত। কেন যে বড়
হতে
গেলো, কেন যে প্রেমে পরতে
গেলো,
কেনই বা মেয়েটিকে বিয়ে করতে
গেলো।
শুধু শুধু মেয়েটা ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে।
যেই
মেয়ে জীবনে কোন ভারি কাজ
করেনি,সে
এখন বাসার সব কাজ একা করে। যেই
মেয়ের দশ-
বারো রকম পদ ছাড়া খাওয়া হতো
না, সে এখন ডাল-
ভাত-ভর্তা খায়। যেই মেয়ের এসি
ছাড়া ঘুমই হতো
না, সে এখন লোডশেডিং,মশার
কামর সব সহ্য করে
নীরবে। সব সপ্নিলের দোষ! জীবনটা
কত
নিষ্ঠুর! ছোটকালে মানুষ যখন
বেহায়া থাকে, মার
খেয়েও পর মুহূর্তে হাসে তখন কোন
সমস্যা
নিয়ে আসে না। যখনই বোধ শক্তি
জাগ্রত হয়
তখনই একটার পর একটা সমস্যা নিয়ে
আসতে থাকে।
ভাবে অনামিকাকে ফোন দিয়ে
একটু কথা বলবে।
কিন্তু কেন যেন থেমে যায়। পড়ে
মানিব্যাগ
থেকে পুরান একটা সিম বের করে অন
করে। এই
সিমটার কথা ওর কয়েকটি রাত
জাগা বাউন্ডুলে বন্ধু ছাড়া
আর কেও জানে না। অনামিকা কে
ফোন দেয়।
অনেকবার কল দাওয়ার পর ফোনটা
ধরে,
- “হ্যালো অনামিকা?”
- “জ্বী! আপনি কে?”
- “রায়হান কবির। মনে আছে?”
- “কে?”
- “সেই রায়হান যার সাথে তোমার
বিয়ে হওয়ার কথা
ছিল আর তুমি বিয়ের দিন
পালিয়েছিলে”
- “আপনি কেন ফোন দিয়েছেন?”
- “তোমার খবর নিতে। তোমার ওই
ফকির
বয়ফ্রেন্ড আই মিন হাসব্যান্ড তোমার
কেমন
খেয়াল রাখে তার খোঁজ নিতে”
- “ফাইজলামি করছেন আপনি?”
- “না তো”
- “খবরদার ওকে নিয়ে বাজে কথা
বলবেন না। আমি
অনেক ভালো আছি,অনেক সুখে
আছি”
- “ওহ তাই নাকি? তো সেই ফকিরটা
কি এখন ডাকাতি শুরু
করলো নাকি? ওকে ফেলে আমার
কাছে চলে
আসো। এখনও সময় আছে। রাজরানির
মতো
রাখবো তোমাকে”
- “ফাইজলামির জায়গা পান না?
মেয়েদের সাথে কথা
বলতে গেলেই মাথায় বেরাম হয়?
অসভ্য,ইতর,ছোটলোক”
কথা গুলো বলেই ঠাস করে ফোন
রেখে দেয়
অনামিকা। অবাক হয়ে যায় সপ্নিল।
ওর কণ্ঠ চিনল না?
আর অনামিকা তো কখনই সপ্নিল
ছাড়া অন্য কারো
সাথে সামান্য রাগ টাও করে না,
আর আজকে এভাবে
কথা বলল? হয়তো নির্মম সত্যটা
শোনার পর আর
সহ্য করতে পারেনি। অনেক রাগ করে
আছে
মেয়েটা। সবই তো সপ্নিলের দোষ।
মনটা আবার
খারাপ হয়ে গেলো। সপ্নিল তো
চেষ্টা
করছেই, কত কষ্ট করছে। চায়ের
দোকানের
ছোট ছেলেটাকে ডাক দিয়ে বলে,
- “এক গ্লাস পানি দে তো”
- “হায় আল্লাহ! স্যার আপনি রোজা
রাখেন না?”
- “রোজা রাখি না তোকে কে
বলল?”
- “তয় পানি চান ক্যা?”
- “খাব না, মাথায় ঢালবো। মাথা
গরম হয়ে আছে
অনেক”
- “তো হেইডা কন। এই লন। আহারে
স্যার রোজা
রাইখে কত কাম করেন”
- “তাও জীবন চলে নারে। যাই হোক,
দাম কত এক
গ্লাস পানির”
- “দশ টেকা”
-“দশ টাকা? এত কেন?”
-“না স্যার। মানে ঈদের সময় তো তাই
বাড়াইয়া চাইলাম
আট টেকা। আমরা তো গরীব মানুষ।
তাই একটু চাইয়াই
লই”
- “এই নে বিশ টাকা”
- “খারান ভাংতি কইরা লইয়া আহি”
- “ভাংতি লাগবে না। বাকিটা
তোর”
- “হায় স্যার কি কোন? রোজার দিন
এতো হারাম খাই
নে”
- “ ওই টাকা তোর। বকশিস ঈদের জন্য”
- “বিশ টেকা দিলাইন?কেও দুই
টেকার বেশি বাড়ায়
দেয় না।দশ টেকা চাই, কিন্তু সকলে
গাইল দেয়।
তাও চাই। আমাগোরও তো শখ হয় নুতুন
কাপুর পরার।
আপনেই দিলাইন।ধইন্নবাদ স্যার।
খারান সালাম করি”
- “না না সালাম করতে হবে না। তো
এটা দিয়ে কি
করবি?”
- “চকলেট কিনুম, মুরি কিনুম, কদমা
কিনুম। তারপর
ঈদের দিন আমার চাইর ছোট ভাই
বোনরে ভাগ
কইরা দিমু। আম্মারেও দিমু। খুশি হইব”
- “এতেই খুশি?”
- “হ স্যার। আমরা গরীব মানুষ। আর খুশি
হইয়া যাই
দিবাইন তাতেই খুশি হইতে হয়।
আপনি মেডাম আপারে
কিছু দিতাইন না?”
- “হুম দিব তো”
হ্যাঁ! আজ সপ্নিল তার প্রিয়তমার জন্য
একটি সুন্দর শাড়ি
নিয়ে যাবে ঈদ উপলক্ষে। সেদিন
বাড়ি ফেরার
সময় দেখে গিয়ছিলো গুলশানের
একটি শো-
রুমে। গাড় নীলের মধ্যে শুভ্র সাদার
কারুকাজ।
শারিটি পড়লে অনামিকাকে খুব
সুন্দর লাগবে। মনে
হবে নীল আকাশে সাদা মেঘের
ভেলায় এক
পরী পা ঝুলিয়ে বসে হাসছে। পনের
হাজার টাকা দাম
শারিটার। বাসার থেকে এতদিনের
জমানো সব টাকা
নিয়ে বের হয়েছে সপ্নিল। আজ পণ্য
পৌঁছে
দাওয়ার উপর যত কমিশন পাবে সব
মিলিয়ে শারিটি
কিনবে। ঈদ উপলক্ষে সেমাই,দুধ,
চিনি, মুরগি, মসলা,
চাল সব কিনবে। আর এ থেকে যদি
কিছু বাঁচে
তাহলে নিজের জন্য কিছু কিনবে।
বিয়ের পর প্রথম
ঈদ। তিন বছর ধরে কত সপ্নই না
দেখেছে এক
সাথে ঈদ করার। তাই এই ঈদ টাকে একটু
বিশেষ
করতে চায় সপ্নিল। প্রথম সব কিছুর
মধ্যেই এক
অপরিমেয় আনন্দ থাকে। বিয়ের পর
থেকে
মেয়েটা শুধুই কষ্ট করছে। একটা নতুন
শাড়ি পর্যন্ত
দিতে পারেনি। বাসর ঘরে শত
রঙ্গিন ফুলের
ফুলসজ্জার বদলে সপ্নিল অনামিকার
হাতে এনে
দিয়েছিল সারাদিনে বাশি হয়ে
যাওয়া একটি বেলি
ফুলের মালা। তাতেই বোকা
মেয়েটা যে কি খুশি
হয়েছিল। খোপায় গুজে বারবার
দেখাচ্ছিল। আজ
এই শাড়িটা পেলে কি যে খুশি
হবে। নীল রঙ ওর
খুব প্রিয়। কষ্টের রঙ নীলকে যে
কিভাবে
মেয়েটা এতো ভালবেসে আপন
করে নেয়
কিছুতেই বুঝতে পারেনা সপ্নিল!
আরও অনেক গুলো পণ্য পৌঁছে দিতে
হবে।
রিক্সা ভাড়া আর সময় বাচাতেই
পায়ে হেটে পথ
চলছে। এই টাকা দিয়ে ছোট একটা
কিছু হয়তো
কেনা যাবে। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে
রিং রোড এর একটা
বাড়িতে গিয়ে কলিং বেল
বাজায়। বাড়ির কর্তা দরজা
খোলা মাত্রই চিল্লিয়ে উঠে,
- “এতো দেড়ি কেন হু?”
- “স্যার দশ মিনিট দেড়ি হয়েছে
মাত্র। আমি দুঃখিত”
- “তোমাদের মতো ছোটলোকরা
সময়ের
মুল্য কি বুঝবে? বাড়ি বাড়ি গিয়েই
টাকা পাও তো, বুঝ
না কিছু। অপদার্থ!”
সপ্নিল চুপচাপ সব শুনে টাকাটা
নিয়ে বাসা থেকে
বেড়িয়ে আসে। এসব কথা ওকে
রোজই শুনতে
হয়। আগে মন খারাপ হতো, তখন তার
মার কথা খুব
মনে পরত। এখন সয়ে গেছে।
নিজেকে সে
একজন অপদার্থই মনে করে। হয়তো
অনামিকাও
মনে করে! ইস! কেন যে তার বাবা
টেবিলের তলা
দিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে
তুলেনি। তাহলে ওকে আজ
এভাবে কষ্ট পেতে হতো না।
টেবিলের তলা
দিয়ে যারা টাকার খেলা
খেলতে জানে তাদের
চরিত্রের আদর্শ থাকে না, ভালো
মন্দ বুঝার ক্ষমতা
থাকে না।
এভাবে আরও বাসায় বাসায় পণ্য
ডেলিভার করে
অফিসে গিয়ে সব কাগজ পত্র জমা
দেয়। কমিশন ও
ঈদের বোনাসটা নিয়ে দ্রুত
গুলশানের দিকে
হাঁটতে থাকে। ওর অফিস থেকে
শো-রুম মাত্র বিশ
মিনিটের রাস্তা। শর্টকাট এ দ্রুত
যাওয়ার জন্য একটা
গলিতে ঢুকে হাঁটতে থাকে। খুব
শুনশান। হঠাৎ দুইটা
হোন্ডায় ছয় জন ছেলে এসে ওকে
ঘিরে
ধরে। পেটের কাছে চাকু ধরে যা
ছিল সব
কেরে নেয়। এমনকি হাতের
ঘড়িটাও। বাধা দাওয়ার
চেষ্টা করেছিল, লাভ হয়নি। সপ্নিল
নীরব পাথুরে
মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে।
দাড়িয়ে থাকা ছাড়া তো
আর কিছু করারও ছিল না। কিছুক্ষণ
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে
বাসায় চলে যায়।

সন্ধায় চুপচাপ ইফতার খেয়ে ঘরে
চলে গেলো
সপ্নিল। আজ একটি বারের জন্যও
অনামিকার দিকে
তাকায়নি, লজ্জ্বায়। অনামিকা
কিছুক্ষণ আশপাশ দিয়ে
ঘুরঘুর করে বারান্দায় চলে যায়।
অনেকক্ষণ হয়ে
গেলো। প্রায় দুই ঘণ্টা। কিন্তু
অনামিকা এখনও এল না।
কি যেন খানিকক্ষণ চিন্তা করে
নিজেও বারান্দায়
গিয়ে দাঁড়ালো অনামিকার
পাশে। উদাস নয়নে রাতের
অন্ধকার আকাশ দেখছে মেয়েটি।
নীরবতার বাধ
ভেঙ্গে সপ্নিল নিজেই কথা বলে
উঠলো,
- “কালকে ঈদ”
- “ওহ তোর তাহলে মন আছে যে
কালকে ঈদ”
- “তা থাকবে না কেন? আমাদের
প্রথম ঈদ। কিন্তু
আমি তোকে কিছু দিতে পারলাম
না। খুব সাদামাটা ঈদ
করতে হবে এবার। মাফ করে দিস”
- “আমি প্রতি ঈদে ছয় থেকে সাতটা
নতুন জামা
কিনতাম। সাথে ম্যাচিং
স্যান্ডেল, জুয়েলারি ও আরো
অনেক কিছু। ঈদের দিন সকালে
টেবিলের সামনে
গিয়েই নিজের পছন্দের সব খাবার
দেখতে
পেতাম। যতটুক খেতে ইচ্ছা করতো
খেতাম।
এবার তার কিছুই হবে না। কি করা
উচিৎ এখন আমার?”
- “আমি তো চেষ্টা করছিই।
অনেকগুলো টাকাও
জমিয়েছিলাম তোর জন্য শাড়ি
কিনব বলে, কালকে
ভালো কিছু খাব বলে। কিন্তু...”
- “কিন্তু কি? বল”
- “আজকে বাসায় ফেরার পথে সব
ছিনতাই হয়ে
গেছে। আটকানোর চেষ্টা
করেছিলাম, পারিনি”
- “ছিনতাই? আগে বলিস নি কেন?
তোকে কিছু
করে নি তো? বল না,চুপ করে আছিস
কেন?”
- “না আমাকে কিছু করে নি। কিন্তু
সব নিয়ে
গেছে। আব্বুর দেয়া ঘড়িটাও”
- “উফ! তুই কেন এসব করিস?”
- “তোর জন্য একটা শাড়ি খুব পছন্দ
হয়েছিল।
বিয়ের পর থেকে খুব কষ্ট করে আছিস।
তাই
ভাবছিলাম একটা গিফট দিয়ে তোর
মন ভালো করে
দিব। কিন্তু তাও পারলাম। আমি
আসলেও অপদার্থ”
- “চুপ কর তুই! আমি কি কিছু চাইসি
কখনো? আমি তো
পরিণতি সব জেনেই তোকে বিয়ে
করছি। আমার
রাজকীয় জীবন ছেড়ে তোর হাত
ধরে
সামনে চলে আসছি শুধু তোর সাথে
থাকবো
বলে, শুধু তোকে পাব বলে। আর সেই
তুই এখন
আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস।
আমি তো এসব
টাকা পয়সা চাই নাই তোর কাছে,
শুধু তোর সাথে
থাকতে চাই। কে বলেছে তোকে
সারাদিন
খেটে টাকা কামায় শাড়ি
কিনতে যেতে?আজকে
কিছু একটা যদি হয়ে যেত তাহলে
কি হতো?আমি
টিউশনের টাকা বাচিয়ে বাচিয়ে
তোর জন্য একটা
পাঞ্জাবি আর নিজের জন্য একটা
সুতি শাড়ি কিনেছি
তো”
- “তুই তো আগে বলিস নি?”
- “বলি নি?আরে বলব কেমনে? তোর
সময়টা কই?
বল তো তুই শেষ কবে আমাকে ঠিক
মতো
দেখেছিলি?আমার সাথে কথা
বলেছিলি? মনে
আছে তোর? কত কথাই তো আগে
বলতি। সারাদিন
আমার সাথে কথা বলবি, আমার হাত
ধরে বৃষ্টিতে
ভিজবি, একসাথে ঈদের চাঁদ
দেখবি, একসাথে পূর্ণিমা
দেখবি। কই? দিনের পর দিন যায়
তোর সাথে হু হা
ছাড়া আর কোন কথাই হয় না। কত
পূর্ণিমা গিয়ে
অমাবস্যা আসে, চাঁদ দেখা হয় না।
আজকে ঈদের
চাঁদ টাও একসাথে দেখতে পারলাম
না। তোর দিকে
যখনই তাকাই তখনই ক্লান্তি, হতাশার
এক ছায়া মূর্তি
দেখি। আমার সপ্নিল কে খুঁজি,
কিন্তু পাই না।
নিজেকে তখন খব অপরাধি মনে হয়।
এই
অপরাধবোধ তিলে তিলে কষ্ট
দিতে থাকে,
প্রচণ্ড কষ্ট। আজকে ওই রায়হান ফোন
দিয়েছিল।
তোকে নিয়ে কত আজেবাজে কথা
বলছিল।
রাগে আমার মন চাচ্ছিল
লোকাটাকে মারি। সাহস কত!”
কথা গুলো বলেই কেদে ফেলে
অনামিকা।
নিজের উপরই খুব রাগ হয় সপ্নিলের।
আসলেই
তো! অনামিকা যদি তার বিলাসী
জীবনটাকেই বেশি
ভালোবাসত, তাহলে তো আর সব
জেনেও তার
হাত ধরে চলে আসতো না। একটি
বারের জন্যও
পিছু ফিরে দেখে নি মেয়েটি। আর
এই
মেয়েটিকে নিয়েই সে কত কি না
ভাবছিল
আজকে। সত্যিই তো, কত দিন ওর
সাথে কথা বলে
না, ওকে ঠিক মতো দেখে না,
কতদিন একটি
বারের জন্যও মেয়েটির চোখের
দিকে তাকিয়ে
বলেনি ভালোবাসি। কত ওয়াদাই
তো করেছিল
সপ্নিল। বলেছিল কোনদিন
অনামিকার চোখে এক
ফোঁটা পানিও আসতে দিবে না,
কিন্তু মেয়েটি যে
আজ তার ভুলেই অঝরে কাঁদছে। বড্ড
অভিমান
করতে পারে অনামিকা। কিন্তু তার
এ অভিমান করাটাও
যে ভুল না। তবে এই অভিমান
ভাঙ্গানোর এক
অদ্ভুত মন্ত্র জানে সপ্নিল। আসলে
মন্ত্র-তন্ত্র
কিছু না। সপ্নিলের সাথে কিছুইতেই
বেশিক্ষণ রাগ
করে থাকতে পারেনা অনামিকা।
- “সরি বাবু। আর এমন করবো না। সত্যি
সত্যি”
- “খবরদার কথা বলবা না আমার
সাথে”
- “আমার অনামিকা আমরা সাথে
কথা বলবে না? আচ্ছা
এই যে কান ধরলাম”
- “আমি এখনও রাগ করে আছি”
- “আমি কিন্তু কান্না করে দিব।
তারপর সবাই ভাববে
অনামি তার হ্যান্ডসাম,ভালো
বরটাকে মারছে। তারপর
কিন্তু এলাকার সব সুন্দরীরা এসে
তোর উপর হামলা
করবে। আর তুই যে হারগিলা। এক ফু
তেই উইড়ে
যাবি”
কথাটা শুনেই হেসে দেয়
অনামিকা। খুব বেশি হাসির
কিছু বলেনি সপ্নিল। তবুও এমন ভাবে
হেসে কুটিকুটি
হচ্ছে যেন বিশাল একটা কৌতুক বলে
ফেলেছে
সপ্নিল। হাসলে মেয়েটিকে খুব
সুন্দর লাগে। আর
অভিমানি কান্নার পর এমন ভাবে
হাসি দেখলে মনে
পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন এই
মেয়েটির মধ্যেই
আছে। হঠাৎ এক অদ্ভুত প্রশান্তি ভর
করলো
সপ্নিলের মধ্যে।
- “অনামি”
- “হুম বল”
- “তুই এভাবেই অভিমান করে থাকবি
আর আমি তোর
অভিমান ভাঙ্গাব, ঠিক আছে?”
- “তাই নাকি? আচ্ছা। এরপরে আরও
বেশি করবো”
- “ঠিক আছে জানটা। আলাব্যু
এত্তওওওওও গুলা”
- “এই আস্তে। সবাই শুনবে তো”
- “শুনলে শুনবে। আমার বউ কে আমি
যা খুশি বলব,
তাদের কি?”
- “সবাই বলবে এতো সুন্দর, লক্ষি
মেয়েটার বরটা
কত্ত বোকা। আই লাভ ইউ টাও ঠিক
মতো বলতে
পারে না। তখন এলাকার সব
ব্যাচেলররা এসে বাসার
সামনে লাইন ধরবে। তোর ঘষেটি
বেগম
দেখলে অজ্ঞানই হয়ে যাবে”
কথাগুলো বলে আবার হাসতে
থাকে। এবার হাসির
সাথে কিঞ্চিত লাজুক রেখাও
অনামিকার নরম গাল
দুটো ছুয়ে গেছে। অবাক হয়ে চেয়ে
আছে
সপ্নিল। কি যে মায়াবী লাগছে,
যেন নেশা ধরিয়ে
দেয়! অনামিকার হাসি মাখা মুখটি
দেখে খুব তৃপ্তি
লাগছে সপ্নিলের। আজ দুপুরে ঘটে
যাওয়া
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিষন্নতা কখন
যে ম্লান হয়ে
গেছে বুঝেও নি। ভেবেছিল এই ঈদ
টা খুবই
দুঃক্ষজনক ভাবে কাটবে, কিতু এখন
তার মনে হচ্ছে
এটাই হবে ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ ঈদ।
একসাথে
ঈদের চাঁদ দেখার কথা ছিল দুজনার।
কিন্তু মান-
অভিমানের খেলায় চাঁদ আকাশেই
মিলিয়ে গেছে,
অন্ধকার নেমে এসেছে, তারারা
জেগে
উঠেছে আপন আলোয়। কিন্তু
সপ্নিলের কাছে
অনামিকার মুখের হাসিটিই ঈদের
চাঁদের মতো সুন্দর,
তার থেকে একটু বেশিই। কেননা এই
চাঁদ একান্তই
সপ্নিলের নিজের,তার একার সম্পদ!
সপ্নিল নিজেকে অনেক ভাগ্যবান
মনে করে,
জীবনে অনামিকার মতো একটি
মেয়েকে
পেয়ে। ভাগ্যিস কিউপিড
অনামিকা নামক ভালোবাসার
তীরটি খুঁজে খুঁজে সপ্নিলের হৃদয়েই
মেরেছিল! মনে মনে সে
হাজারবার তাই কিউপিড
কে ধন্যবাদ জানায়। সপ্নিল জানে
কিউপিড শুধু
রুপকথাতেই আছে। কিন্তু ওর কাছে
সবকিছু কেমন
যেন রুপকথার মতোই লাগে। এক সুন্দরী
রাজকুমারি ও এক সাধারন ছেলের
ভালোবাসা এবং একটা
হ্যাপি এন্ডিং! কিন্তু বাস্তবতা
তো কোন রুপকথা নয়
যে এখনি শেষ হয়ে যাবে। সুখ-দুঃখ,
হাসি-কান্না, মান-
অভিমান গুলোকে সঙ্গী করে, এই
ভালোবাসার
মানুষের হাত ধরেই চলতে হবে আরও
অনেকগুলো পথ, পুরো একটা জীবন।
সৃষ্টিকর্তার এ এক অদ্ভুত
লীলাখেলা! ভালোবাসা
নামক কি এক আবেগ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে
ছড়িয়ে
দিয়েছেন। যখন কারো মাঝে এই
আবেগটি
জেগে উঠে, তখন শত বিলাসীতা
ভুলে, কষ্টকে
আপন করে শুধু ভালোবাসার মানুষের
হাতটি ধরেই
কাটিয়ে দেয় একটা জীবন।
সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই
সপ্নিল-অনামিকার মতো এসব
ভালোবাসার কাঙ্গাল
মানুষগুলোকে দেখে সন্তুষ্ট হন এবং
তাঁর রহমত
বরশন করেন। তাদের দেখে হয়তো
ইন্দ্রের
অপ্সরীরাও আনন্দে নাচছে। নিশ্চয়ই
কোন এক
জায়গা থেকে অদৃশ্য কিউপিডও
খুসিতে মুচকি মুচকি
হাসছে।

No comments:

Post a Comment