Saturday, July 23, 2016

স্বর্গীয় সঙ্গিনী

স্বর্গীয় সঙ্গিনী

লেখকঃ ফেরারী ফেরিম্যান


এই উঠো! আর কত ঘুমাবে। জোহরের আযান
হয়ে গেছে। জামাত মিস করলে খবর আছে
বলে দিলাম!

স্ত্রীর ভালবাসামাখা ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে
বসল সুফিয়ান। সেল্ফ থেকে মিসওয়াক হাতে
নিয়ে ঢুকে পড়ল বাথরুমে। রমজান বলেই আজ
তাযকিয়ার সাথে দুষ্টোমি না করে গোসলে ঢুকল
সুফিয়ান। তাযকিয়া সুফিয়ানের স্ত্রী।
.
১০মিনিটে গোসল শেষ করে বের হল।
স্বামীর শরীরে লোশন মাখিয়ে পাঞ্জাবী
এনে দিল তাযকিয়া। সুফিয়ান পাঞ্জাবী পরতে
পরতে টুপিটা ও এনে হাজির করল। স্বামীকে
মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করিয়ে নিজেও
জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।
.
নামাজ শেশে ঘরে ফিরে সুফিয়ান দেখল তাযকিয়া
কোরআন পড়ছে। কি মিষ্টি তার তেলাওয়াত! সুফিয়ান
যেন পাগল হয়ে যায়!! সে বারবার আল্লাহর দরবারে
শুকরিয়া আদায় করে এমন এক মহীয়সী সঙ্গিনী
দান করার জন্যে। সত্যিই একজন নেককার স্ত্রী
পারে একজন অমানুষ কে সুনার মানুষে বদলে
দিতে, একজন ড্রিংকার কে পাঁচওয়াক্ত নামাজী
বানাতে, একজন চেইন স্মোকার উশৃঙখল যুবক
কে শান্তশিষ্ট আর সামাজিক হিসাবে গড়ে তুলতে।
.
সুফিয়ান ভেবেছিল নামাজ পড়ে এসে নিজে
তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তাযকিয়ার মোহময়
কণ্ঠে মিষ্টি স্বরে তেলাওয়াত শুনে সে
নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে অন্য এক জগতে।
পূতপবিত্র শান্তিময় এক জগতে। এটা সেই জগত,
যেখানে আত্মা পরম আনন্দে থাকে। যেখান
থেকে অশান্তি আর হাহাকার পালিয়ে বেড়ায়
ক্রোশ ক্রোশ দূরে। যে জগত জোড়ে
থাকে স্বর্গের শান্তি,অমিয় আনন্দ আর ঐশ্বরিক
উচ্ছাস।.
.
পাঁচবছর আগের কথা!
সুফিয়ান তখন HSC পরীক্ষা শেশ করে বেকার।
বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে, তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে
কোনো চিন্তা ছিলনা তার।
কিন্তু ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় ছিলেন
সুফিয়কনের বাবা-মা। কলেজ লাইফেই যথেষ্ট
বখে গিয়েছিল সুফিয়ান। আপন মা-বাবার সামনে
স্মোক করত। ড্রিংক করতো ঘরে বাইরে। আর
মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি তো তার নিত্য দিনের রুটিন ছিল।
.
এই অল্প বয়সে দু-তিনবার জেলে ও যেতে হয়
সুফিয়ান কে। প্রথম প্রথম ছেলেমানুষী
ভাবলেও পরে বিচলিত হয়ে পড়েন সুফিয়ানের বাবা
মা। ছেলের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকারে দেখতে
পান তারা। অনেক চেষ্টা করেও কোনো
ফলাফল না পেয়ে তারা পরামররাশ চাইতে শরণাপন্ন
হন মসজিদের ইমামের।
.
ভাগ্যিস তাদের মসজিদের ইমাম সাহেব একজন
হক্কানী আলেম ছিলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন
সুফিয়ান কে কোনো সুপাত্রী দেখে বিয়ে
দিয়ে দিতে। হয়তো এর দ্বারা কোনো ভাল
ফলাফল আসতে পারে!
পরামর্শ মতে সুফিয়ানের বাবা-মা লেগে যান পাত্রির
সন্ধানে।
.
অনেক খুঁজে অবশেষে তাঁরা তাযকিয়ার সন্ধান পান।
বাপ-মা মরা মেয়েটির অভিভাবক মামা-মামি। যেমন
সুন্দরী তেমন বিচক্ষণা মেয়ে। তার উপর মাদ্রাসা
পড়োয়া এবং ধার্মিক। প্রথমবার দেখেই মুগ্ধ হয়ে
যান তারা। ছেলের জন্য তাযকিয়াকে পছন্দ করে
ফেলেন সুফিয়ানের বাবা মা।
.
সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কেবল সুফিয়ান ছাড়া। সে
বিয়েতে মুটেই রাজি ছিলনা। অবশেষে সবার
চাপে পড়ে রাজি হল এবং বিয়েও করল। কিন্তু
তাযকিয়াকে সে মন থেকে গ্রহণ করল না।
স্বামীর কাছে তাযকিয়ার অবস্থান হল ডাসটবিনের
মত। যখন খুশি ইউজ করলাম, বাদ বাকি কে রাখে কার
খবর!
.
এভাবে কেটে গেল তিনটি বছর। এই তিনবছরে
সুফিয়ান আরো অনেক বেশি নিচে নেমে
গেল। সে তাযকিয়ার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা
করতনা। একসময় তার বাবা-মা ও তাযকিয়াকে বললেন
ডিভোর্স নিয়ে নিতে। চোখের সামনে একটি
প্রস্ফোটিত গোলাপকে অসময়ে ঝরতে
দেখা তাদের সহ্য হচ্ছিল না!
.
কিন্তু তাযকিয়া ছিল অনড়। যেভাবেই হোক, সে
স্বামীকে সতপথে ফিরিয়ে আনবেই!
রাতবিরেতে সুফিয়ান যখন মাতাল হয়ে ঘরে ফিরত,
তাযকিয়া তাকে পরম মমতায় বিছানায় শুইয়ে দিত। তার
মাথায় হাত বুলিয়ে দিত।
আর প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে স্রস্টার কাছে
সুফিয়ানের জন্য প্রার্থনা করত।
.
অবশেশে একদিন খোদা তার প্রার্থনা মঞ্জুর
করলেন!
.
হঠাত সুফিয়ানের প্রচন্ড জ্বর হল। জ্বরের
প্রকোপে কয়েক সপ্তাহ বিছানা থেকে মাথা
তুলতে পারলনা।
এই কদিন তাযকিয়া পাগলের মত সুফিয়ানের সেবা
করল। স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে সর্বস্ব
উজাড় করে তার শুশ্রূষায় লেগে রইল। খোদার
মহিমা বোঝের ঊর্ধ্বে! এই অল্প দিনে তাযকিয়ার
প্রতি সুফিয়ানের মায়া সৃস্টি হয়ে গেল।
.
সুফিয়ান ধীরেধীরে তাযকিয়ার প্রেম জালে ধরা
পড়ল। হৃদয়ের চোখ দিয়ে সে যখন
মেয়েটিকে দেখল, তখন তার মাঝে বিরাট
পরিবর্তন চলে আসল। মনে মনে সে
নিজেকে ধীক্কার দিতে লাগল। সে ভাবতে
লাগল, এমন পরীর মত নারী ঘরে রেখে
কেউ কি করে নেশা করতে পারে!
.
অল্পদিনে সুফিয়ান অনেক বেশি বদলে গেল।
এখন আর সে তাযকিয়াকে মারধর করেনা। ড্রিংক
করাও ছেড়ে দিয়েছে।
এদিকে তাযকিয়া প্রভূর কাছে আরো বেশি কান্নাকাটি
করে। যেন তার স্বামী খুব তাড়াতাড়ি তার আপন
হয়ে যায়। যতটা খারাপ এতদিন ছিল, তার থেকে
অনেক বেশি ভাল হয়ে যায়!
.
খোদা তাযকিয়ার ডাকে সাড়া দেন। একদিন তাযকিয়া
সুফিয়ান কে বল্ল তাবলীগ জামাতে যেতে।
সুফিয়ান সাথে সাথে রাজি হয়ে যায়। চলে যায় চল্লিশ
দিনের জন্য আল্লাহর রাস্তায়।
.
চিল্লা শেষে যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন
সুফিয়ান টুটাল চেঞ্জড! বাবাকে সালাম করতে তিনি
সুফিয়ান কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন!
হয়তো এটাই ছেলের কাছ থেকে পাওয়া
জীবনের প্রথম সালাম ছিল! মা ও অনেক খুশি
হোন তার উপর। সেদিন যেন জান্নাতের শান্তি
নেমে আসে তাদের পরিবারে।
.
সুফিয়ানের পরিবার ধনাঢ্য হলেও প্রথম থেকে
ধার্মিক ছিলনা। তাযকিয়া স্বামীর ঘরে এসেই
প্রথমে সেদিকে নজর দেয়। কুরআন-হাদিসের
কথা আর ইসলামিক ঘটনাবলি শোনিয়ে শ্বাশুর-শ্বাশুড়
িকে ধার্মিকতার ছোঁয়ায় নিয়ে আসে। বেঁকে ছিল
শুধু সুফিয়ান। খোদায় দয়ায় সেও এখন সু-পথের
পথিক!
.
সুফিয়ান এখন পাঁচওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে
পড়ে। বাবা-মা কে যথেষ্ট কেয়ার করে। আর
তাযকিয়ার কাছে অতিতের আচরণের জন্য বারবার
ক্ষমা চায়।
যে মানুষগুলা আগে সুফিয়ানকে রাস্তার কুকুরের
সাথে তুলনা করতো তারাও এখন দেখলে সালাম
করে! সুফিয়ান সৃস্টিকর্তাকে বারবার শুকরিয়া জানায়
তাকে নতুন করে সুন্দির একটি জীবন দান করার
জন্যে!
.
.
তাযকিয়া এখনো তেলাওয়াত করছে। আর তার কুলে
মাথা রেখে সুফিয়ান হারিয়ে আছে অন্যএক
জগতে। এমন জগত যেখানে আত্মা তৃপ্ত
থাকে,চিত্ত শান্ত থাকে, আর মানুষ পায় সুপথের
সন্ধান!
.
সুফিয়ান বারবার দুয়া করে 'হে প্রভু! তুমি ঘরে ঘরে
জন্ম দাও এমন পুণ্যবতী নারী, প্রতি ঘরে এনে
দাও এমন মহীয়সী বধু, সব পুরুষের কপালে
লিখে দাও এমন স্বর্গীয় সঙ্গিনী যার আলতো
স্পর্শে জং ধরা জীবন হয়ে যায় পরশপাথর তুল্য।
অমানুষ হয়ে যায় সুনার মানুষ, আত্মভোলা ফিরে পায়
নিজের সঠিক পরিচয়'
.
তাযকিয়ার মধুর তেলাওয়াত লহরিতে হারিয়ে আছে
সুফিয়ান। স্ত্রীর প্রতি ভক্তি ভরা ভালবাসার এ এক
জান্নাতী আবেশ। দুনিয়ায় আখেরাতের স্বাদ লাভ!
আর পরকালে তো তাযকিয়ারাই হবে জান্নাতী
হুরদের সর্দারনী, আর সুফিয়ানরা তাদের গর্বিত
সঙ্গী!
.
প্রতি ঘরে আসুক এমন জান্নাতি পরিবেশ।
ঘরেঘরে জন্ম নিক একজন তাযকিয়া। সকল পুরুষের
ভাগ্যে থাকুক একেকজন নেককার স্ত্রী,,
খোদার তরে এই প্রার্থনা।।

ফেরারী ফেরিম্যান

No comments:

Post a Comment